সিডনির চিঠি: চা বাগানের লামিয়া ও আমি

আমি তখন সবে মাস্টার্স শেষ করে সিলেটের কুলাউড়ায় একটা চা বাগানে চাকরিতে ঢোকেছি। লোভনীয় বেতন আর আরামের চাকরি।

নাইম আবদুল্লাহ, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2017, 10:18 AM
Updated : 21 August 2017, 10:18 AM

চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকের এই চাকরির আয়েশ আমি আর কোন চাকরিতে পাইনি। খুব ভোরে উঠে টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়াই। আসলে টিলার বাবুরাই সব কাজের তদারকি করেন। আমার কাজ শুধু শ্রমিকদের মাথা গুনে দেখে হাজিরা খাতায় সই করা। ঠিক আটটায় ফিরে এসে সকালের নাস্তা করা। সকালে কী নাস্তা খাবো তার তালিকা আগের রাতেই বাবুর্চিরা জেনে রাখেন।

চা বাগানে চা পান করার একটা বনেদি তরিকা আছে। ট্রলিতে করে টি পট, গরম পানি, দুধ, চিনি, চা পাতি সব নিয়ে এসে সামনে রাখেন। তারপর খানসামা দাঁড়িয়ে থেকে অনেক্ষণ ধরে চা বানিয়ে দেন। চা নাস্তা খেয়ে একটু আরাম করে আবার সাড়ে দশটার সময় ফ্যাক্টরিতে যাওয়া। ফ্যাক্টরি বাবুরাই সব কাজের দেখভাল করেন। টি টেস্টিং করতেও ওরা ওস্তাদ লোক। একটার মধ্যে বাসায় ফিরে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে জমিদারি স্টাইলে দুপুরের খাবার খওয়া।

দুপুরের ভাত ঘুমের আমেজ কেটে গেলে ইচ্ছেমতো বিকেলে ফ্যাক্টরিতে যাওয়া, তারপর ইচ্ছেমত ফিরে আসা। মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরি চালু থাকলে কিংবা শিপমেন্টের জন্য চা পাতার পেটি ট্রাকে লোড হলে তখন সারপ্রাইজ ভিজিট করা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ক্লাবে গিয়ে সারারাত আড্ডা ও মাস্তি করা। জিপ গাড়ি, মোটর সাইকেল, পেট্রোল, ড্রাইভার সব ফ্রি।

এই জমিদারি জীবন আমার না। তার উপর সদ্য পড়াশুনা শেষ করেছি। সব আড্ডা ঢাকায় ফেলে গিয়েছি। ম্যানেজার সাহেব কাজে কামে প্রায়ই ঢাকায় থাকতেন। তাই সব দায়িত্ব অফিসিয়ালি আমাকেই পালন করতে হতো। একবার কুলিদের পাড়ায় বিয়ের ধুম লাগলো। সেখানে আশীর্বাদ দিতে সাহেবদের যেতে হয়। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা।

কুলিরা সাহেবকে দেবতা মানেন। বর-বধু মাটিতে শুইয়ে কুর্নিশ করে দোয়া চাইলো। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হলো আগুন নিয়ে উপজাতীয় নৃত্য। পানের জন্য ছিল তাড়ি, চরস, রাতের খাবার বিশেষ ধরনের ছাতুর রুটি ও শুকরের পোড়া মাংশ, সাহেবের জন্য সিলেট থেকে আনা নান রুটি, কাবাব আর বিদেশি মদ।

ওই রাতেই লেবার কলোনিতে লামিয়া নামে ক্লাস টেনে পড়ুয়া একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। দূর থেকেই অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম একটি মেয়ে আমাকে ইশারা করে, আমার সামনে আসতে চায়। কিন্তু লেবার কলোনির অন্যান্যরা তাকে আসতে দিতে চাইছে না। এক ফাঁকে আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বাবুকে বললাম, মেয়েটিকে নিয়ে আসতে।

মেয়েটি ভয়ে ভয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তারপর মাটিতে শুয়ে আমাকে প্রণাম করলো। আমি তাকে উঠে দাঁড়াতে বললাম।

-কী নাম তোর?

মেয়েটি কিছুক্ষণ ভয়ে মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। বাবু তাকে ধমকের সুরে বললেন, সাহেব তুকে কী বুলছে?

-সাহেব, আমি লামিয়া গো।

-তুই কি আমাকে কিছু বলবি।

লামিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ওর বাবা এসে প্রণাম করে বলেন, মালিক লামিয়া আমার মেয়ে আছে। ও ক্লাস টেনে পড়ছে।

আসলে বাগানে একটা পাঠশালা আছে, কিন্তু কোন শিক্ষক নেই। কেউই এখানে এতো অল্প বেতনে চাকরি করতে চায় না। মাঝে মাঝে বাবুরা গিয়ে ক্লাস নেন। লামিয়া মেয়েটা বাগান থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে একটা হাই স্কুলে সাইন্সে ক্লাস টেনে পড়ে। তার বইপত্র কিছুই নেই।

আমি ম্যানেজারকে অনুরোধ করে ওর স্কুলের ফি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেও তিনি বইপত্র কেনার পয়সা দিতে রাজি হলেন না। একদিন সিলেট থেকে গাড়িতে করে বাংলোতে ফিরছি। দেখি লামিয়া মেয়েটি স্কুল থেকে হেঁটে আসছে। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে ওকে গাড়িতে তুলে নিতে বললাম। ড্রাইভার কিছুতেই রাজি না হওয়ায় ওকে ধমক দিলে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে লামিয়াকে জিপের পেছনে তুলে নিল। মেয়েটা পেছনের সিট রেখে গাড়ির ফ্লোরে কয়েদিদের মতো বসে পড়লো। আমি তাকে সিটে বসতে বললেও সে কোনভাবেই রাজি হল না।

ড্রাইভার ব্যাপারটা ম্যানেজারকে জানালো। তিনি একজন রিটায়ার্ড মেজর। আমাকে বাগানের নিয়মকানুন বোঝাতে গিয়ে একটি ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। পরদিন আমি সিলেটের একটি বইয়ের দোকান থেকে লামিয়ার জন্য ক্লাসের সব বই-খাতা কিনে বাবুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। বাগান থেকে ছুটি নিয়ে ওইদিন রাতের ট্রেনেই আমি ঢাকা চলে আসলাম। পরদিন হেড অফিসে গিয়ে চাকরি ছেড়ে দিলাম।

২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে গেছি। গরম সহ্য না করতে পেরে আমি রিটার্ন টিকেটে দেওয়া বুকিং এর আগেই সিডনি চলে আসতে চাইলাম। তাই টিকেট কনফার্ম করতে থাই এয়ারলাইন্সের অফিস হোটেল শেরাটনে গেলাম। টিকেট কাউন্টার থেকে বলা হলো যেহেতু আমার টিকেট বিশেষ ডিসকাউন্টে কেনা তাই তারিখ পরিবর্তন করতে পারবো না। আমি বললাম, কিন্তু সিডনি থেকে আমাকে বলা হয়েছিল যদি আমি তারিখ পরিবর্তন করি তাহলে আমাকে ২৫% অতিরিক্ত দিতে হবে। টিকেট কাউন্টারে থাকা ভদ্রলোক আমাকে একরকম অপমান করেই বের করে দিলেন। আমি বাধ্য হয়ে ওদের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম এবং লিফট দিয়ে তিনতলায় উঠে গেলাম।

ম্যানেজারের টেবিলে বসে সবকথা বলার এক পর্যায়ে মেয়েটা আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে থেকে ভূত দেখার মতো ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালো। বিস্ময়ের ধাক্কা সামনে উঠতে আমার কিছু সময় লাগলো। মেয়েটি আমার টিকেট আর পাসপোর্টে লেখা নামটি দেখে নিশ্চিত হয়ে বলল, সালাম, ছোট সাহেব। তারপর কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নিঁচু করে আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।

আমি এতক্ষণ রাগে, দুঃখে আর অপমানে মেয়েটির মুখের দিকে পর্যন্ত তাকাইনি। একটি উপজাতীয় মেয়েকে কুর্নিশ করা অবস্থায় দেখে আর তার শাড়ির ভাঁজে পিন দিয়ে আটকানো লামিয়া নামটির দিকে চোখ পড়তেই আমি আবার ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম।

অনেক বছর পর দেখা হওয়ার ধাক্কা সামলানোর পর লামিয়া জানালো, আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। যতই দিন গড়াতে থাকে এই ভাবনাটা ততই তার মনে দৃঢ় হয়। এসএসসি ও এইচএসসি’তে খুব ভালো রেজাল্ট করে সে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে থাই এয়ারলাইনন্সে চাকরি পায়। তারপর প্রমোশন পেয়ে সে স্টেশন ম্যানেজার হয়েছে।

চাকরি পেয়ে ঢাকায় এসেই সে আমাদের হেড অফিসে যোগাযোগ করে আমার কোন খোঁজ-খবর পায়নি। সে সিডনি অফিসে ফ্যাক্স করে আমার টিকেটের টার্মস অ্যান্ড কনডিশন এনে পরীক্ষা করে জানাল, আমাকে ২৫% অতিরিক্ত দিয়ে টিকেট রি-বুকিং করতে হবে। সে তার স্টাফের দুর্ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলো এবং ওইদিন রাতেই আমার সিডনি ফেরার ব্যবস্থা করে তার গাড়িতে করে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল।

লেখক: সিডনি প্রবাসী ও সাংবাদিক

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন