দেশে যারা থাকেন, তারা হয়তো ব্যাপারটা খুব সহজে বুঝতে না-ও পারেন। কিন্তু যারা দেশের বাইরে ছিলেন বা আছেন, তারা ঠিকই বুঝতে পারবেন।
অনেক সময় এমনও হয় যে বিদেশের মাটিতে দেশের কোনকিছু না দেখতে পেয়েও মনে কষ্ট লাগে। হয়তো মনে প্রশ্নও জাগে, বাংলাদেশ কোথায়?
বিদেশের মাটিতে দেশের কোনও প্রতিষ্ঠান, পতাকা বা দোকানপাট খুব একটা দেখা যায় না। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তাই হঠাৎ করে দেশের কিছু একটা দেখলে মনের আনন্দ-আবেগ সামলাতে না পারাটাও খুব স্বাভাবিক!
আমার চাচা সহিদুর রহমান (সোনাই মিয়া) দুবাইয়ে চাকরি করার সময়ে মিশর দেশের এক আরবি ভাষার লোককে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম কয়েক লাইন শিখিয়ে গিয়েছিলেন। চাচা দেশে চলে যাওয়ার অনেক বছর পরও ওই মিশরীয় লোকটি মাঝে মধ্যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাইতো।
আর মজার ব্যাপার হলো, গাওয়া শেষে ‘সুনা মিয়া আমার বন্ধু’- এই কথাটা বলতেও কখনও ভুলতেন না। যদি কেউ প্রথম শোনে, তাহলে মনে করবে ‘সুনা মিয়া আমার বন্ধু’- এই লাইনটা সঙ্গীতেরই অংশ।
থমকে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। কমপক্ষে এক মিনিট দাঁড়িয়েছিলাম তো বটেই। ধরে নিতে পারেন, জন্মভূমির পতাকা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করে দেশের প্রতি সম্মান জানিয়েছিলাম।
হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, স্পেন দেশের কোনও এক হোস্টেলে আবার বাংলাদেশের পতাকাই বা কেন থাকবে? আমার জানা মতে, এর তিনটি কারণ হতে পারে!
প্রথমত, নির্দিষ্ট পরিমাণ বাংলাদেশি পর্যটক ভ্রমণে এসে এই হোস্টেলে রাত্রি যাপন করেছেন, বিধায় বাংলাদেশ এটা অর্জন করেছে। দ্বিতীয়ত, কোনও বাংলাদেশির বিশেষ অনুরোধে পতাকাটি আঁকা হয়েছে। তৃতীয়ত, হোস্টেলটি কোনও বাংলাদেশি মালিকের। নাহলে মাত্র বিশ-পঁচিশটা দেশের পতাকার মাঝে বাংলাদেশের পতাকার জায়গা করে নেওয়ার কথা না!
একবার এক ইংরেজিভাষী বিদেশি নাগরিকের সাথে পরিচয় হলো। একজন আরেকজনকে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করছিলাম। আমি বললাম, আমার দেশ বাংলাদেশ। উনি বললেন তার দেশের নাম-ধাম ইত্যাদি। উনি আমার গায়ের রঙ দেখেই আমার সাথে ভারতের গল্প শুরু করে দিলেন।
বিদেশি এই নাগরিকের গল্পে সন্দেহ হলে তাকে আমি পাল্টা একটা প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি জানো, বাংলাদেশ কোথায়? উত্তরে তিনি বললেন, তার ধারণা সেটা ভারতের কোনো জায়গায়। মানে তার ধারণা- বাংলাদেশ ভারতের কোনও একটা শহরের নাম!
তারপর আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এটি ভারতের খুব কাছাকাছি একটা দেশ। তবে বাংলাদেশ কোনও দেশের সাথে শরীক নয়।
যাহোক, পরে ভদ্রলোকের কিছুটা হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা হয়েছে। আর তখন বাংলাদেশের প্রশংসা ছেড়ে অহেতুকই আমার প্রশংসা করতে শুরু করলেন। বললেন, তুমি খুভ ভালো মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি!
আমি অবশ্য এটা ভেবে গর্ব বোধ করলাম যে অন্তত একজন বিদেশিকে নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশ চেনাতে পারলাম!
দীর্গ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে যদি মসলার দোহাই দিয়ে ভারতের কোনও শহর বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কষ্ট লাগাটাই স্বাভাবিক। কে জানে, বিদেশের মাটিতে কে বা কারা আমাদের দেশকে নিয়ে এমন অপপ্রচার চালিয়েছে। নাকি দোষ আমাদের নিজেদেরই!
বিদেশের মাটিতে একবার এক প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইয়ের সাথে পরিচয়। আমি যে দেশে থাকি, উনি সেই দেশের প্রতিবেশী দেশেই থাকেন। উনি সেই দেশে একটি বড় রেস্তোরাঁয় বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন। রেস্তোরাঁয় কি সব খাবার পাওয়া যায়, কোন দেশি কাস্টমার বেশি আসেন- এসব আমি জানতে চাইলাম।
উনি বললেন, এটি ভারতীয় রেস্তোরাঁ, তাই দেশি খাবারই পরিবেশন করা হয়। আমি বললাম, তাহলে তো আপনাকে ভারতীয় সহকর্মীদের সাথে কাজ করতে হয়? উনি বললেন, না, আমার সব সহকর্মী বাংলাদেশি এবং রেস্তোরাঁটিও বাংলাদেশি মালিকানাধীন। শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম!
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের ‘কাউসান রোড’ নামক রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে বিশেষ এক ধরনের ছোট-ছোট বিভিন্ন দেশের পতাকার মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা দেখতে পেলাম। সেটাতে হাত বুলিয়ে খুব ভালো লেগেছিলো।
তার একটাই কারণ! বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা যেদেশে ভ্রমণ করলেন, সেই দেশ থেকে নিজের দেশের পতাকা কিনে শার্ট-জ্যাকেটে লাগিয়ে নেন। আবার অনেকে বাড়ি নিয়ে যান ভ্রমণ স্মৃতি মনে রাখার জন্যে।
এবার শুনুন দেশের কিছু দেখতে না পাওয়ার কষ্ট।
থাইল্যান্ডের ভ্রমণ এজেন্সির দোকানগুলোর সামনে ভ্রমণ বিজ্ঞাপনের মধ্যে প্রথমে হচ্ছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের ভ্রমণ বিজ্ঞাপন। তারপর আশেপাশের দেশগুলোর ভ্রমণ বিজ্ঞাপন।
আমাদের পাশের দেশ ভারত, মায়ানমার, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের ভ্রমণ বিজ্ঞাপন থাকলেও আজ পর্যন্ত বিদেশি পর্যটকদের জন্যে বাংলাদেশে ভ্রমণে যাওয়ার কোনও বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম না। তাই বলে আমাদের দেশে যে বিদেশি পর্যটক একেবারে আসেন না, আমি সেটা বলছি না।
উপরে উল্লেখিত এসব দেশের নাগরিকরা এ সকল দেশে ঘুরতে গিয়ে বিদেশি পর্যটকদের জন্যে রাখা তাদের নিজ দেশের ভ্রমণ বিজ্ঞাপনের দেখে নিশ্চয়ই আনন্দিত হন। শুধু আমিই হতাশ!
জার্মানিতে কয়েক বছর হয়ে গেলো! এখানকার আলদি, লিডল, কাউফল্যান্ড নামের সুপারমার্কেটগুলো দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ প্যাকেজও বিক্রি করে।
সুদূর ইউরোপের দেশেও আমাদের আশপাশের দেশগুলির ভ্রমণ প্যাকেজ
আমি আমার এক বিদেশি বন্ধুকে বলেছিলাম, চলো বাংলাদেশ ঘুরতে যাই। সে বলল, ভয় লাগে। কাউকে যাইতে তো শুনি নাই।
আবারও মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ কোথায়?
দেশের পর্যটন কর্তৃপক্ষকেই বেশি করে দেশের দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে প্রচার করার পাশাপাশি বিদেশি বন্ধুর মনের ভয়কে দূর করারও ব্যবস্থা করতে হবে।
হয়তো কোনও একদিন অন্য দেশের কোনও এক শহরে ঘুরতে গিয়ে বাংলাদেশের ভ্রমণ বিজ্ঞাপন দেখতে পাব। আর সেদিন দরদাম না করেই বুক করে নেব।
আর ব্যাংককের কাউসান রোড থেকে কেনা লাল-সবুজের পতাকা সেলাই করে নিজের পিঠে লাগিয়েই যাব সেদিন। তখন বিদেশি বন্ধুরা সেটা দেখে আর বলতে পারবে না যে কাউকে বাংলাদেশ যাইতে তো দেখি নাই।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ইমেইল- md.naim@aol.com
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন |