কোরিয়ার চিঠি: বিদেশ বিভূঁইয়ের ভালো-মন্দ

‘তোর তো ব্যাংক ভর্তি টাকা, এতো টাকা দিয়ে কী করবি?’-এই কথাটা আমার দাদী সব সময় আমার আব্বাকে বলতেন।  

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2017, 04:49 AM
Updated : 15 August 2017, 04:49 AM

আমার আব্বা দেশের বাইরে থাকতো, সেজন্য এই কথাটা সব সময়ই শুনতে হয়েছে আব্বাকে। আর এখন শুনতে হয় আমাদের। সত্যি বলতে, আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এখনও সেই বদ্ধমূল ধারণাটা রয়ে গেছে। বাস্তবতাটাকে কেউ বুঝেও যেন বুঝে উঠতে চায় না।

এই ধারণার সাথে আরও একটি সুস্পষ্ট ধারণা নিয়েই থাকে দেশের মানুষ,  আর তা হচ্ছে- ‘বিদেশ মানেই সব ভালো’। যতো দোষ, সব আমাদের দেশেরই। এখানে যে নিজের দেশকে ছোটো করা হচ্ছে, ওইটা কিন্তু অনেকেই চিন্তা করে দেখি না আমরা। আসলেই কি আমাদের ভালো কিছুই নেই?

এইতো জ্যাম, বিদ্যুৎ থাকে না, দেশে অনেক গরম ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক আছে, সবই মানলাম। কিন্তু দেশে থাকার যে শান্তি, সেটার সাথে কিন্তু বিদেশের তুলনা হয় না। সব সময়ই একটা আকস্মিক ভয় কাজ করে। সবার নাও করতে পারে। কিন্তু আমার এই ভয়টা হয়।

আমাকে এখানে থাকতে হচ্ছে দেখে যে এইখানের সবই আমার ভালো লাগতে হবে, তা কিন্তু একদমই নয়। বলছি না সব খারাপ। ওদের সংস্কৃতির সাথে আমাদের সংস্কৃতির কোনও মিল নেই। তাই কিছু কিছু জিনিস আমার ভালো নাই-ই লাগতে পারে। ব্যাপারগুলো খুবই সাধারণ, তারপরও আমাদের বেশ কষ্টই করতে হয়।

আমাদের পরিবার-পরিজন যারা দেশে আছে, তারা প্রথমেই চিন্তা করে- বিদেশ আছি, কতো ভালো আছি।  হ্যা, ভালো আছি সত্যি। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই ধরুন, দেশে আমরা বাসা খালি অথবা তালা না দিয়ে কোথাও যেতে পারি না। কিন্তু এখানে আপনি ঘর-বাড়ি তালা না দিয়েও বাইরে যেতে পারবেন।

এই অভিজ্ঞতা আমার অনেক হয়েছে। এরকম অনেক দিন হয়েছে যে আমরা বাসা তালা না দিয়েই ঘুরতে গিয়েছি। এটা কিন্তু আমরা দেশে চিন্তাই করতে পারি না। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘নিরাপত্তা’।

নিরাপত্তার কথা কেউ কখনও আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। অবশ্য আমি এটুকু বলতে পারি, রাত-দিন যখনই হোক না কেন, আপনি এখানে নির্বিঘ্নে একা চলাফেরা করতে পারবেন। সেটা রাত ২টা হোক বা ৩টা।

অপরাধ তো সবখানেই আছে। কিন্তু অন্য সব জায়গার তুলনায় অনেক অনেক কম এখানে। কোরিয়ানরা এখন অনেক বেশি সভ্য। ওরা অনেক কষ্ট করে নিজেদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এজন্য ওদের যে সুযোগ-সুবিধাগুলো আছে, ওইগুলো আমরাও পাচ্ছি।

তবে একটু ভালো থাকার জন্য কিন্তু আমাদেরও কম কষ্ট করতে হচ্ছে না! যতো প্রবাসী আছি, আমরা সবাই কিন্তু অনেক পরিশ্রম করেই এই সুবিধাটুকু পাচ্ছি। একটু নিরাপত্তা, একটু সচ্ছলতা। আচ্ছা, দেশে সবাই কী নিজের কাজ নিজে করে খায়? নাহ, করে না। চাকরি, পড়াশোনা, রান্না,  ঘর গুছানোসহ অন্যান্য সব কাজই কিন্তু আমাদের নিজেদের করতে হয়।

যাই হোক, এখন বলি আমার কী কী সমস্যা। প্রথমে এসেই যে সমস্যায় ভুগেছে, সেটা হচ্ছে- ‘ভাষা’। এই ভাষার জন্যই মূলত অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কোরিয়ানরা একদমই ইংরেজি বোঝে না।

তারপর আরেক সমস্যা হচ্ছে, বাসা ভাড়া নেওয়া। অনেক বাড়িওয়ালা বিদেশিদের বাসা ভাড়া দিতে চায় না। ভয় পায়। আর বাসাতে ওঠার পর শুরু হয় ভাষাগত সমস্যা। সাধারণত বাড়িওয়ালারা অনেক বয়স্ক হয়, যারা নাকি একদমই ইংরেজি পারে না। তখন বাসায় কোনও সমস্যা হলে বাড়ির মালিককে বোঝানো আরেক ঝামেলা। তখন যে বাঙালি কোরিয়ান বলতে পারে, তার সাহায্য নিতে হয়। খুবই বিরক্তিকর। আসলে কোরিয়ান না জানলে বেশ কষ্টই এখানে।

এরপর যদি বলি তাহলে বলতে হয়- বাচ্চাদের স্কুল। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে কোনও ডে-কেয়ার নেই। যতো ডে-কেয়ার সব কোরিয়ান। সেখানে এক-দুইটা ইংরেজি ক্লাস থাকে।  আর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে ব্যয় অনেক বেশি। যেটা কিনা সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। যেজন্য সবার ইচ্ছা না থাকলেও বাচ্চাদেরকে কোরিয়ান মিডিয়ামে দিতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা সমস্যা।

এখন অনেকেই বলতে পারেন, কোরিয়ান শিখলে সমস্যা কী? সমস্যা আসলে কিছুই নেই। কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমি আমার বাচ্চাকে কোরিয়ান মিডিয়ামে দিতে চাচ্ছি না। এখানে আসলে কিছুই করার নেই। আপনার যদি সামর্থ্য থাকে, তাহলে আপনি ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াবেন। আর নাহলে আপনার সন্তানকে কোরিয়ান মিডিয়ামে পড়াতে হবে। তবে ওদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক অনেক বেশি ভালো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।  

দেশ থেকে আসার সময় তো মনে করেছিলাম যে ঘরে বসে তো আর থাকবো না, কিছু না কিছু অবশ্যই করতে পারবো। কিন্তু স্পাউস ভিসাতে চাকরি করা যায় না। এটাও আমার জন্য অনেক বড় সমস্যা। কিন্তু আপনি যদি কোরিয়ান ভাষা জানেন, তাহলে কোনও না কোনও চাকরি তবু পেতেও পারেন।

এখানে স্কুলগুলোতে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরিগুলো খুব ভালো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ স্কুলগুলোতেই ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের শর্ত হচ্ছে মাতৃভাষা ইংরেজি হতে হবে। এইদিক থেকেও সমস্যা আমার জন্য।

এখানে যে যতো ভালো কোরিয়ান ভাষা রপ্ত করতে পারবে, কোরিয়ায় থাকা তার জন্য ততো সহজ। তবে এসব ছোটখাটো বিষয় আসলে তেমন প্রভাব ফেলে না এখানে থাকতে। কোরিয়াতে যারা এসেছে, আর যারা বর্তমানে আছেন, শুধু তারাই খুব ভালো জানেন যে কোরিয়া কতোখানি উন্নতি করেছে।

আর পৃথিবীর সব জায়গাতেই ভালো-মন্দ আছে। ওদেরও আছে, কিন্তু আমরা আসলে বিদেশের ভালোটাই দেখতে চাই। দোষগুলোর দিকে খেয়াল করি না। খেয়াল করাটাও ঠিক না। তাহলে নিজের দেশের দোষগুলোই কেন শুধু দেখি?

আমাদেরও গর্ব করার অনেক কিছু আছে। আর ভালো হোক বা মন্দ হোক, আমার কাছে আমার দেশ-ই সবচেয়ে ভালো।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: shajia.shila@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!