যুদ্ধাপরাধের বিচারে গতি আনতে প্রতি বিভাগে ট্রাইব্যুনালের দাবি

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হান্নান খান।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2017, 08:17 AM
Updated : 10 August 2017, 08:17 AM

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা, কন্ঠযোদ্ধা এবং মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় অনানুষ্ঠানিক এক মত বিনিময় সভায় একথা বলেন পারিবারিক সফরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত হান্নান খান।

যুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় ৭০০ মামলা অপেক্ষমান রয়েছে জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, “প্রত্যেক বিভাগে একটি করে অর্থাৎ মোট আটটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব।

“বর্তমানের একটি মাত্র ট্রাইব্যুনাল দিয়ে বিচার চালালে পৌনে ৭০০টি মামলার বিচার শেষ করতে অন্তত ৭০০ বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর অনেক আগেই সব অভিযুক্ত রাজাকারের মৃত্যু হবে।”

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হান্নান খান বলেন, “বিচারক সঙ্কটের অজুহাতে গত বছর একটি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করায় এখন মাত্র একটি ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। এর ফলে পেন্ডিং মামলার সংখ্যা বাড়ছে, যা এখন পৌনে সাতশতে উপনীত হয়েছে।

“অথচ এই আইনেই বলা হয়েছে বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি অনেক আগেই। বাংলাদেশের প্রতিটি ডিভিশনে একটি করে মোট আটটি ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। তাহলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ভিকটিম পরিবার বেঁচে থেকে ঘাতকদের শাস্তি দেখে যেতে পারবেন।”

২০১০ সালে একটি ট্রাইব্যুনাল দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলেও কাজ গতিশীল করতে দুটি করা হয়েছিল। পরে মামলার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রাইবুনাল-১ এর সদস্য বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হককে চেয়ারম্যান করে একটিতে নামিয়ে আনা হয়।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিচারপতি আনোয়ারুল হক গত ১৩ জুলাই মারা যাওয়ার পর ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ না হওয়ায় যুদ্ধাপরাধের মামলার বিচারকাজ বন্ধ আছে।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন আইনমন্ত্রী।

ইতোমধ্যে গত মঙ্গলবার খুলনার আটজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে অপেক্ষমান মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দুটি ট্রাইব্যুনালকেই সচল করার কথা বলেছেন প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক।

তবে প্রবাসের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় দুই ট্রাইব্যুনাল সচল না হওয়া ও সংখ্যা না বাড়ার পেছনে বিচারক সঙ্কটের প্রসঙ্গে বলেন প্রসিকিউশনের প্রধান সমন্বয়ক হান্নান খান।

আব্দুল হান্নান খান।ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তিনি বলেন, ‍“বাংলাদেশে বর্তমানে বিচারকের সঙ্কট রয়েছে, এমন কথা ইতোমধ্যেই প্রধান বিচারপতিও উল্লেখ করেছেন। এ কারণে এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের শুন্য পদটিও পূরণ করা সম্ভব হয়নি।”

“একটি বিষয় সকলেরই জানা থাকা উচিত যে, গুরুতর অপরাধের অভিযোগ কখনোই তামাদি হয় না। তাই একাত্তরের অপরাধীরাও রেহাই পাবে না। এ জন্যে প্রয়োজন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো।”

দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিলের পরও বিচার শুরু না হওয়ার পেছনেও বিচারক সঙ্কটকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখালেও প্রসিকিউশন টিমের দায়িত্বের কথাও বলেন হান্নান খান।

তিনি বলেন, “বিচারকের সঙ্কটে একটি মাত্র আদালতও ঠিকমত কাজে সক্ষম হচ্ছে না। ২০১১ সালে আমি এ দায়িত্ব হাতে নেই ৪২৫টি অভিযোগসহ। তারপর আদালতের সংখ্যা একটি থেকে দুটি করা হয়। কিছুটা ত্বরান্বিত হয় বিচার প্রক্রিয়া।

“একটি বিষয়ে সকলের ধারণা থাকা উচিত যে, আমরা প্রাপ্ত অভিযোগের তদন্ত শেষে তা পেশ করি প্রসিকিউশন টিমের কাছে। তারা সেই নথিপত্র বিশ্লেষণ করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উত্থাপন করেন আদালতে। সে অনুযায়ী আমরা জামায়াতের তদন্ত প্রতিবেদন বিস্তারিতভাবে পেশ করেছি। অবশিষ্ট দায়িত্ব হচ্ছে প্রসিকিউশন টিমের।”

‘সরকারি দলের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে কিনা’ এমন প্রশ্নে তা সরাসরি অস্বীকার করেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সময়ন্বয়কারী।

“এমন গুঞ্জন আরো অনেক মামলা নিয়ে ছিল, বাস্তবে সেগুলো ধোপে টেকেনি। আইন অনুযায়ী বিচার শেষে ফাঁসিতে ঝুলিয়েই ঘাতকদের দম্ভ চূর্ণ করা হয়। তাই ট্রাইব্যুনালের সঙ্কট কমলেই প্রসিকিউশন টিম নিশ্চয়ই জামাতের বিরুদ্ধেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মাননীয় আদালতে পেশ করবেন।”

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের সংখ্যা ও তদন্তের অগ্রগতির একটি পরিসংখ্যানও আলোচনায় তুলে ধরেন হান্নান খান।

তিনি বলেন, “৩৭২৪ রাজাকারের বিরুদ্ধে ৭১৪ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫২টির তদন্ত সমাপ্ত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন তথা চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে- এমন অভিযুক্ত রাজাকারের সংখ্যা ১৪৪। রায় ঘোষণা করা হয়েছে ২৯টি মামলার।

“তদন্তকালে অভিযুক্তদের মৃত্যু হওয়ায় পাঁচটি মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে শীর্ষ ছয় রাজাকার-ঘাতকের। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে ২৩ জন আত্মগোপনে রয়েছে, যার মধ্যে দুজন এই আমেরিকায়। এদের বাংলাদেশে নিয়ে রায় কার্যকর করতে সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”

যুক্তরাষ্ট্রে আত্মগোপনে থাকা যুদ্ধাপরাধে ট্রাইব্যুনালের বিচারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলবদর আশরাফুজ্জামান এবং রাজাকার আব্দুল জব্বারকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিতে ১৩ অগাস্ট নিউ ইয়র্ক সিটির জ্যামাইকায় মানববন্ধনের আয়োজন করেছে ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’র যুক্তরাষ্ট্র শাখা।

এ উপলক্ষে প্রস্তুতি কার্যক্রম প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক হান্নান খানকে অবহিত করা হয়।

মত বিনিময় সভায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়, এ প্রজন্মের কন্ঠশিল্পী শাহ মাহবুব, যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ আহমেদ, নিউ ইয়র্কে ‘আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব’র সভাপতি লাবলু আনসার এবং সেক্রেটারি শহীদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!