পুরো দুনিয়াতে তো চায়নিজ খাবারের খুব নামডাক আছেই। তবে কোরিয়ান খাবারও কিন্তু সুস্বাদু।
কোরিয়াতে আসার আগে ওদের খাবারের যেসব গল্প শুনেছি সেগুলো রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো ছিলো। ওরা নাকি সাপ, ব্যাঙ, কুকুর-এইসব খায়। শুনেই তো বাঙালির অরুচি চলে আসে তাই না...!
গাড়িতে, ট্যাক্সিতে, কোনও দোকানে গেলে, কোনও কোরিয়ানদের পাশ দিয়ে গেলেও ওই ‘গন্ধ’টা অবশ্যই পেতাম। বিশেষ ‘গন্ধ’টার সাথে মানিয়ে নিতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু ট্যাক্সিতে উঠলে এখনও মাঝে মাঝে পাই।
এর পাশাপাশি এখানে অন্য আরও একটি গন্ধ পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে ‘সোজু’, মানে কোরিয়ানদের স্থানীয় অ্যালকোহল। ‘সোজু’ ছাড়া যেন ওদের আড্ডাই জমে না। খাবারের পানি থেকে ‘সোজু’র দাম কম। আর ওরা যেদিন চিকেন ফ্রাই খাবে সাথে অবশ্যই বিয়ার থাকবেই।
প্রথম কিছুদিন এই গন্ধের জন্য কোথাও কোরিয়ান খাবার খেতে পারিনি। কিন্তু কোরিয়াতে আসার পর থেকেই দেখছি প্রত্যেক অলিতে গলিতে খাবারের দোকান। আর এখানে বাইক যত না ছেলেরা চালায়, তার থেকে বেশি বাইক চালায় হোম ডেলিভেরি ম্যান। সাথে স্ট্রিট ফুডের দোকান। আর স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক কফি শপ খুবই জনপ্রিয় এখানে।
তবে ওদের ‘কিমবাপ’ অথবা ‘গিমবাপ’টা খুব মজা। সাদা ভাত, সাথে আপনার পছন্দমতো সবজি, ডিম, আর ইচ্ছামত শাক-সবজি দিয়ে কিম, মানে শুকনো সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে মুড়ানো ভাতের রোল। আমাদের খুব প্রিয় একটি খাবার।
তবে আমরা সব কোরিয়ান খাবার খেতে পারি না। অনেক বাঙালি অবশ্য কোরিয়ান কোনও খাবারও খায় না। কেননা, এখানে হালাল খাবার খুব সহজলভ্য না। সিউলে তাও অনেক হালাল খাবারের দোকান আছে, কিন্তু সব শহরে অত হালাল খাবার পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ মুসলিম বাঙালিরা হালাল খাবারটা মেনে চলে এইখানে।
অ্যারাবিয়ান, পাকিস্তানি দোকান ছাড়া তো বাইরে আমরা মাংস খেতে পারি না। তবে আমরা বাইরে ‘সি-ফুড’ আইটেমগুলো খাই। অনেকে তাও খায় না। আমরা খাই। এছাড়া সবজি আইটেমটাই বেশি খাই আমি। ‘বিবিম্বাপ’। ভাতের সাথে পাঁচ-ছয় রকমের সবজি, একটা সস এবং সাথে ডিম ভাজা। খুব খুব স্বাস্থ্যকর একটা খাবার। আর খেতেও খুব মজা। আমার সবচেয়ে প্রিয়। অবশ্য যখন কোরিয়ান মাংসের খাবার খুব খেতে ইচ্ছা হয়, তখন বাসায় রান্না করে খাই। শোয়েব খুব ভাল কোরিয়ান খাবার রান্না করতে পারে।
চিকেন, রাইস নুডুলস আর সবজি দিয়ে রান্না হয় ‘ঝিমডাক’। ইচ্ছা হলেই শোয়েব বাসায় রান্না করে। অনেক মজাও হয় খেতে। বাসায় অবশ্য আমরা অনেক কোরিয়ান ডিস রান্না করে খাই। কোরিয়ান স্টাইলে বিফ বারবিকিউ, ডাক-গাল্বি, কোরিয়ান ফ্রাইড রাইস।
এতেই ওদের উন্নতি। যেজন্য অলিতে গলিতে খাবারের দোকান। আর খাবারের দোকানগুলো এত পরিষ্কার, খাবারের মান এতো ভাল যে খাওয়ার সময় আপনাকে চিন্তা করতে হবে না যে কী খাচ্ছি না খাচ্ছি?
আর প্রত্যেকটা খাবারের দোকানের হোম ডেলিভেরি আছে। সাধারণত একজনের খাবারের দাম কোরিয়ান উয়ানে চার হাজার থেকে শুরু। সব দোকানের দাম একরকমই। কিছুটা ঊনিশ-বিশ হয়, তবে খুব বেশি না।
ওরা যে একদম বাসায় রান্না করে না, তা কিন্তু না। বেশিরভাগই যারা বয়স্ক, তারাই বেশি রান্না করে বাসায়। তবে কেউ রান্না করুক আর না করুক, সবার বাসায় ‘কিমচি’ থাকবেই। মানে টক-ঝাল প্রিজারভ সবজি। চাইনিজ বাধাকপিটাই বেশি ব্যবহার করে। অবশ্য যেকোনো সবজি দিয়েই করা যায় কিমচি। যেকোনো খাবারের সাথে কিমচি থাকবেই।
খুবই স্বাস্থ্যকরী খাবার এই কিমচি। কোরিয়ানরা খাবারগুলো তৈরিই করেছে স্বাস্থ্যের কথা খেয়াল করে। খুব অল্প তেলে হয় ওদের খাবারগুলো। আমাদের মতো এতো তেল-মশলা দিয়ে রান্না হয় না।
কোরিয়ানরা দুপুরের খাবার খায় ১২টা-১টার মধ্যে। খুব অল্প সময়। আর ডিনারের সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর ডিনারের সময়টা ওরা খুব সময় নিয়ে গল্প করতে করতে খেতে পছন্দ করে। ওরা খেতেও পারে প্রচুর। তবে পরিশ্রমও করে খুব বেশি।
এই সময়টাতে ছুটির দিনগুলোতে সাগরের পানিতে নামতে পছন্দ করে কোরিয়ানরা। চলে যায় সাগর পাড়ে দল বেঁধে পানিতে মজা করতে, সারাদিনের জন্য অথবা দিন-রাত সব সময়ের জন্যই। তাবু টাঙিয়ে পোর্টেবল চুলাতে ‘রামেওন’ মানে নুডুলস রান্না, আর সাথে চলে ঝলসানো মাংস মানে বারবিকিউ করতে করতে আড্ডা। খুব তৃপ্তি করে খেতে পছন্দ করে কোরিয়ানরা। আসলে খাবারটা ওরা সত্যিই খুব উপভোগ করে খায়। আর হ্যা, রামেওনটা কিন্তু চীন, জাপান, কোরিয়া সবখানেই খুব বেশি পছন্দনীয়।
আমাদের মতো কোনও কিছুই খুব সময় নিয়ে ওরা রান্না করে খায় না। বারবিকিউ, সেদ্ধ, রান্না সবই করে খায়, কিন্তু কোনোটাই ওভার কুক না। আসলে কোরিয়ান খাবার খুব বেশি স্বাস্থ্যকর এবং খুব কম খরচেই আপনি খুব মানসম্মত খাবার খেতে পারবেন যদি আপনি ওই গন্ধটা না পেয়ে থাকেন।
আমাদের মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক হচ্ছে কোরিয়ার খাবার দাবার নিয়ে। কাঁচা বাজার থেকে আপনি মাংস ছাড়া আর সবই কিনতে পারবেন। সমুদ্রের মাছ, শাক-সবজি সব একদম তাজা কিনতে পারবেন। কিন্তু মুরগি, গরু, মাটন-এসব কেনার জন্য আপনাকে হালাল দোকান থেকেই নিতে হবে। সব সিটিতেই আপনি হালাল দোকান পাবেন, কিন্তু দেশের মতো অপশন পাচ্ছেন না। হালাল খাবারের জন্য এই ভোগান্তিটুকু আপনাকে করতেই হবে। কিচ্ছু করার নেই।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ইমেইল:
ছবি কৃতজ্ঞতা: সাজিয়া শিলা ও শোয়েব
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |