নাকে অচেনা গন্ধ, মুখে সুস্বাদু কোরিয়ান খাবার

জাপানিজ, চায়নিজ, কোরিয়ান-এইসব দেশের নামের সাথেই যেন কেমন একটা খাবারের সম্পর্ক খুঁজে পাই আমি।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2017, 04:30 AM
Updated : 5 August 2017, 04:35 AM

পুরো দুনিয়াতে তো চায়নিজ খাবারের খুব নামডাক আছেই। তবে কোরিয়ান খাবারও কিন্তু সুস্বাদু। 

কোরিয়াতে আসার আগে ওদের খাবারের যেসব গল্প শুনেছি সেগুলো রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো ছিলো। ওরা নাকি সাপ, ব্যাঙ, কুকুর-এইসব খায়। শুনেই তো বাঙালির অরুচি চলে আসে তাই না...!

আমি যখন কোরিয়াতে আসি, তখন এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই অন্যরকম একটা ‘গন্ধ’ পেয়েছিলাম। বাঙালি যে কেউ আসলেই এ ‘গন্ধ’ পাবে!  অপরিচিত, কেমন অন্য একটা গন্ধ। এই গন্ধের মধ্যেই যেন ওদের খাবারের গন্ধটা মিশে গেছে। আমার কাছে খুবই বিশ্রি ছিলো গন্ধটা।

গাড়িতে, ট্যাক্সিতে, কোনও দোকানে গেলে, কোনও কোরিয়ানদের পাশ দিয়ে গেলেও ওই ‘গন্ধ’টা অবশ্যই পেতাম। বিশেষ ‘গন্ধ’টার সাথে মানিয়ে নিতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু ট্যাক্সিতে উঠলে এখনও মাঝে মাঝে পাই।

এর পাশাপাশি এখানে অন্য আরও একটি গন্ধ পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে ‘সোজু’, মানে কোরিয়ানদের স্থানীয় অ্যালকোহল। ‘সোজু’ ছাড়া যেন ওদের আড্ডাই জমে না। খাবারের পানি থেকে ‘সোজু’র দাম কম। আর ওরা যেদিন চিকেন ফ্রাই খাবে সাথে অবশ্যই বিয়ার থাকবেই।

প্রথম কিছুদিন এই গন্ধের জন্য কোথাও কোরিয়ান খাবার খেতে পারিনি। কিন্তু কোরিয়াতে আসার পর থেকেই দেখছি প্রত্যেক অলিতে গলিতে খাবারের দোকান। আর এখানে বাইক যত না ছেলেরা চালায়, তার থেকে বেশি বাইক চালায় হোম ডেলিভেরি ম্যান। সাথে স্ট্রিট ফুডের দোকান। আর স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক কফি শপ খুবই জনপ্রিয় এখানে।

যতোখানি মনে আছে, আমার প্রথম কোরিয়ান খাবার ছিল ‘তকপকি’ অথবা ‘থপ্পকি’ এবং ‘অদেং’। থপ্পকি হচ্ছে রাইস কেকের সাথে ফিসের একটা ঝাল আইটেম। আর অদেং হচ্ছে মাছের একটা প্রিপারেসন। খুব যে খারাপ লেগেছিল খেতে তা বলবো না, কিন্তু খুব ভালোও লাগেনি। তবে এখন অনেক উপভোগ করি।

তবে ওদের ‘কিমবাপ’ অথবা ‘গিমবাপ’টা খুব মজা। সাদা ভাত, সাথে আপনার পছন্দমতো সবজি, ডিম, আর ইচ্ছামত শাক-সবজি দিয়ে কিম, মানে শুকনো সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে মুড়ানো ভাতের রোল। আমাদের খুব প্রিয় একটি খাবার।

তবে আমরা সব কোরিয়ান খাবার খেতে পারি না। অনেক বাঙালি অবশ্য কোরিয়ান কোনও খাবারও খায় না। কেননা, এখানে হালাল খাবার খুব সহজলভ্য না। সিউলে তাও অনেক হালাল খাবারের দোকান আছে, কিন্তু সব শহরে অত হালাল খাবার পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ মুসলিম বাঙালিরা হালাল খাবারটা মেনে চলে এইখানে।

আসলে কোরিয়া তো আর মুসলিম দেশ না, তাই ওইরকম আশা করাটাও ঠিক না। এর জন্য আমাদের বেশ ভালোই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আমি আর আমার জামাই, খুব ভোজনরসিক। তাই সব সময় সব কিছু খেতে ইচ্ছা করলেও বাইরে খেতে পারি না। কোথাও খেতে যাওয়ার আগে জেনে নিতে হয় যে খাবার হালাল কিনা?

অ্যারাবিয়ান, পাকিস্তানি দোকান ছাড়া তো বাইরে আমরা মাংস খেতে পারি না। তবে আমরা বাইরে ‘সি-ফুড’  আইটেমগুলো খাই। অনেকে তাও খায় না। আমরা খাই। এছাড়া সবজি আইটেমটাই বেশি খাই আমি। ‘বিবিম্বাপ’। ভাতের সাথে পাঁচ-ছয় রকমের সবজি, একটা সস এবং সাথে ডিম ভাজা। খুব খুব স্বাস্থ্যকর একটা খাবার। আর খেতেও খুব মজা। আমার সবচেয়ে প্রিয়। অবশ্য যখন কোরিয়ান মাংসের খাবার খুব খেতে ইচ্ছা হয়, তখন বাসায় রান্না করে খাই। শোয়েব খুব ভাল কোরিয়ান খাবার রান্না করতে পারে।

চিকেন, রাইস নুডুলস আর সবজি দিয়ে রান্না হয় ‘ঝিমডাক’। ইচ্ছা হলেই শোয়েব বাসায় রান্না করে। অনেক মজাও হয় খেতে। বাসায় অবশ্য আমরা অনেক কোরিয়ান ডিস রান্না করে খাই। কোরিয়ান স্টাইলে বিফ বারবিকিউ, ডাক-গাল্বি, কোরিয়ান ফ্রাইড রাইস।  

কোরিয়ানরা কিন্তু খুব বেশি কর্মঠ। ৫০ বছর আগে নাকি ওরা শুধু লতাপাতা খেয়ে থাকতো। অনেক বেশি পরিশ্রম করে এরা। যেজন্য এতো অল্প সময়েই এতো উন্নতি করতে পেরেছে। সময় নষ্ট করে না একটুও। যেটুকু সময় রান্নার পেছনে ব্যয় করবে, তার থেকে ওই সময়টা কাজ করে ব্যয় করতে পছন্দ করে এরা।

এতেই ওদের উন্নতি। যেজন্য অলিতে গলিতে খাবারের দোকান। আর খাবারের দোকানগুলো এত পরিষ্কার, খাবারের মান এতো ভাল যে খাওয়ার সময় আপনাকে চিন্তা করতে হবে না যে কী খাচ্ছি না খাচ্ছি?

আর প্রত্যেকটা খাবারের দোকানের হোম ডেলিভেরি আছে। সাধারণত একজনের খাবারের দাম কোরিয়ান উয়ানে চার হাজার থেকে শুরু। সব দোকানের দাম একরকমই। কিছুটা ঊনিশ-বিশ হয়, তবে খুব বেশি না।

ওরা যে একদম বাসায় রান্না করে না, তা কিন্তু না। বেশিরভাগই যারা বয়স্ক, তারাই বেশি রান্না করে বাসায়। তবে কেউ রান্না করুক আর না করুক, সবার বাসায় ‘কিমচি’ থাকবেই। মানে টক-ঝাল প্রিজারভ সবজি। চাইনিজ বাধাকপিটাই বেশি ব্যবহার করে। অবশ্য যেকোনো সবজি দিয়েই করা যায় কিমচি। যেকোনো খাবারের সাথে কিমচি থাকবেই।

খুবই স্বাস্থ্যকরী খাবার এই কিমচি। কোরিয়ানরা খাবারগুলো তৈরিই করেছে স্বাস্থ্যের কথা খেয়াল করে। খুব অল্প তেলে হয় ওদের খাবারগুলো। আমাদের মতো এতো তেল-মশলা দিয়ে রান্না হয় না।

খেতে গেলে আমার সবচেয়ে মজা লাগে ওদের পরিবেশন দেখলে। আপনি একটা খাবার অর্ডার করবেন, আর সাথে পাবেন হরেক রকমের সাইড ডিশ। কম করে হলেও চার-পাঁচ রকমের। এর থেকে বেশিই হয়ে থাকে সব সময়।

কোরিয়ানরা দুপুরের খাবার খায় ১২টা-১টার মধ্যে। খুব অল্প সময়। আর ডিনারের সময় সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পর ডিনারের সময়টা ওরা খুব সময় নিয়ে গল্প করতে করতে খেতে পছন্দ করে। ওরা খেতেও পারে প্রচুর। তবে পরিশ্রমও করে খুব বেশি।

কোরিয়ানদের খাবারের উত্তম সময় হচ্ছে রাতের খাবার। সাথে যদি হয় বারবিকিউ, তাহলে তো কথাই নেই। এখন তো দেশে কোরিয়ান খাবারের দোকান আছে। অনেক কোরিয়ান খাবারের স্বাদ পাওয়া যায়। কোরিয়ান স্টাইলে ঝলসানো মাংস অনেক বেশি জনপ্রিয় এখানে।

এই সময়টাতে ছুটির দিনগুলোতে সাগরের পানিতে নামতে পছন্দ করে কোরিয়ানরা। চলে যায় সাগর পাড়ে দল বেঁধে পানিতে মজা করতে, সারাদিনের জন্য অথবা দিন-রাত সব সময়ের জন্যই। তাবু টাঙিয়ে পোর্টেবল চুলাতে ‘রামেওন’ মানে নুডুলস রান্না, আর সাথে চলে ঝলসানো মাংস মানে বারবিকিউ করতে করতে আড্ডা। খুব তৃপ্তি করে খেতে পছন্দ করে কোরিয়ানরা। আসলে খাবারটা ওরা সত্যিই খুব উপভোগ করে খায়। আর হ্যা, রামেওনটা কিন্তু চীন, জাপান, কোরিয়া সবখানেই খুব বেশি পছন্দনীয়।

আগে চিন্তা করতাম, ওরা কীভাবে চপস্টিক দিয়ে ভাত খায়? এখানে আসার পর দেখলাম, ওদের ভাত খুব আঠালো হয় আর সেজন্যই দুটো কাঠি দিয়ে ভাত খাওয়া সম্ভব হয়।

আমাদের মতো কোনও কিছুই খুব সময় নিয়ে ওরা রান্না করে খায় না। বারবিকিউ, সেদ্ধ, রান্না সবই করে খায়, কিন্তু কোনোটাই ওভার কুক না। আসলে কোরিয়ান খাবার খুব বেশি স্বাস্থ্যকর এবং খুব কম খরচেই আপনি খুব মানসম্মত খাবার খেতে পারবেন যদি আপনি ওই গন্ধটা না পেয়ে থাকেন। 

আমাদের মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক হচ্ছে কোরিয়ার খাবার দাবার নিয়ে। কাঁচা বাজার থেকে আপনি মাংস ছাড়া আর সবই কিনতে পারবেন। সমুদ্রের মাছ, শাক-সবজি সব একদম তাজা কিনতে পারবেন। কিন্তু মুরগি, গরু, মাটন-এসব কেনার জন্য আপনাকে হালাল দোকান থেকেই নিতে হবে। সব সিটিতেই আপনি হালাল দোকান পাবেন, কিন্তু দেশের মতো অপশন পাচ্ছেন না। হালাল খাবারের জন্য এই ভোগান্তিটুকু আপনাকে করতেই হবে। কিচ্ছু করার নেই।

বিবিম্বাপ, বুকুম্বাপ, হাজার রকমের রামেওন, সি উইড স্যুপ, গেজাং, গালবি, কংগুক্সু, সামগ্যেতাং, কিম্বাপ, চিকেন ফ্রাই...আরও অনেক অনেক কিছু। এতো এতো রকমফের আছে কোরিয়ান খাবারের, যেগুলা একেবারে লিখে শেষ করা যাবে না। তবে সত্যি যে, কোরিয়ান খাবার আসলেই অনেক সুস্বাদু এবং অনেক অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: 

ছবি কৃতজ্ঞতা: সাজিয়া শিলা ও শোয়েব

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!