বাংলাদেশের অনেক পরিবার আছে যারা সহজে মেনে নিতে পারেন না তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি এইখানে‘ওড জব’ বা বাংলাদেশের সমাজ যেটাকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে সে ধরনের চাকরি করুক।
ইংল্যান্ডের লোকেরা কোনও কাজকেই হেয় করে দেখেন না, বরং সব কাজকেই তারা শ্রদ্ধা করেন। সত্যি কথা বলতে সমস্যাটা সম্ভবত আমাদের মনে- আমাদের সমাজ ও মানুষদের।
সমাজে আমরা এমনভাবে বড়ো হয়েছি যেখানে শুধু ডাক্তার, পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার বা এ ধরনের পেশাজীবীদের মূল্যায়ন করতে শেখানো হয়েছে।
নিম্ন আয়ের পেশা তো আছেই, অনেক সময় বেশি আয় হওয়া পেশার মানুষকেও কিন্তু আমাদের সমাজে হেয় করে ভাবতে শেখানো হয়।
বিলেত আসার আগে অন্যান্য মানুষের মতো একই ধরনের ধারণা ছিলো যে, বিলেতে গিয়ে হয়তো ভালো ‘জব’ পাবো।
শুধু পরিবার কেন, বরং আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে প্রশংসার বদলে প্রতিনিয়ত ধিক্কার পেয়েছি। এখন আর খারাপ লাগেনা বরং এইখানে ক্ষণে ক্ষণে সবার কাছ থেকে উৎসাহ পাচ্ছি এই সমস্ত কাজ করার ক্ষেত্রে।
অনেকেই অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসেন এই দেশে পড়াশোনা বা ইমিগ্রান্ট হতে। কেউ আসেন স্কলারশিপ নিয়ে, আবার কেউ বা আসেন মোটা অঙ্কের টিউশন ফিস দিয়ে খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে।
আসার পর নতুন স্বপ্নটি পূরণ করতে গিয়ে পুরাতন স্বপ্নটি একেবারে মুছে যায়। এই ধরুন যদি আমার কথা বলি, তাহলে অবশ্যই বলবো ঠিক আমিও নতুন স্বপ্নটি পুরণ করতে গিয়ে পুরাতনটি একেবারেই মুছে ফেলেছি।
আমার মনে হয় আমার কথাটি বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, তাই না! ঠিক আছে তাহলে বিস্তারিতই বলি। আমি ইংল্যান্ডে আসার আগে পড়াশোনার পাশাপাশি মিডিয়া ও স্কুলে কাজ করেছিলাম বেশ কিছুদিন।
কিন্তু আসার পর সেই পুরনো পেশায় তো যেতে পারলাম না বরং একটি নতুন ও ভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত হয়ে গেলাম, যেখানে মানুষকে অনিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও যেতে হয়।
ফুডশপ, পাব, ক্লাব, ক্লিনিং, সিকিউরিটি প্রভৃতি এই সমস্ত জবগুলোকে আমরা নিচু মানের কাজ বা ‘ওড জব’ বলে থাকি কিন্তু এই দেশে আসার পর যখন দেখতে পেলাম এখানকার মানুষ প্রত্যেকটি জব বা চাকরিকে সম্মানের চোখে দেখে, এরপর থেকে আমারও আগ্রহ, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।
বাংলাদেশের মানুষদের চিন্তা-ভাবনা, ভাবভঙ্গি ও মনমানসিকতা একেবারে ভিন্নরকম। যেমন- তারা এখনো মনে করে অন্যদেশে বা বিলেতে জব পাওয়াটা কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু ধারণাটি যে একেবারে ভুল, এটি তারা বুঝতে চান না। বললেই কিন্তু ‘ফাস্টক্লাস জব’ করা যায় না। এই দেশে কিছু নিয়মকানুন রয়েছে, যেটা আমাদের সবাইকে মেনে চলতে হয়। চাইলেই কিন্তু আপনি নিয়ম ভেঙ্গে অন্যকোনও কাজ করতে পারবেন না।
যেমন- ক্লাস ফাঁকি দেওয়া যাবে না এবং কাজের অনুমতি যতো ঘণ্টা অনুযায়ী পাবেন, তার বেশি বা ফুল টাইম জব করতে পারবেন না। এমনকি চাইলেও আপনি স্টুডেন্ট থাকার সময় অন্যকোনো পেশায় যেতে পারবেন না।
বরং উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, চিন্তাভাবনা ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে বিলেতে আসার পরিকল্পনা করতে হবে। শুধু যে ইংল্যান্ডে তা নয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও স্টুডেন্টদের ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের নিয়ম রয়েছে।
ঠিক আমাদেরই মতো একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাসী ছয় বছর আগে এসেছিলেন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে লন্ডনে।
তিনিও ভেবেছিলেন হয়তো আগের ডিগ্রি নিয়ে এদেশে জব বা চাকরি করতে পারবেন। কিন্তু যা ভেবেছিলেন তার পুরোপুরি উল্টো হয়েছে। এরকম অনেকেই আছেন যারা বাংলাদেশের ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়েও এ ধরনের ‘ওড জব’ করে যাচ্ছেন। তাই বলে এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং বুঝতে শিখেছি প্রত্যেকটি জবের সম্মান ও মূল্যায়ন।
তাছাড়া এখানে কিন্তু সর্বনিম্ন স্কেল অনুযায়ী ঘণ্টার ভিত্তিতে বয়স অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। যেমন- বয়স ২৫ অথবা এর বেশি হলে ঘণ্টায় ন্যুনতম পারিশ্রমিক হবে সাড়ে ৭ পাউন্ড, বয়স ২১ থেকে ২৪ হলে ঘণ্টায় ন্যুনতম ৭ পাউন্ড ৫ সেন্টস, ১৮ থেকে ২০ বয়সের কর্মীরা ৫ পাউন্ড ৬০ সেন্টস এবং ১৮ এর নিচে হলে ঘণ্টায় কমপক্ষে ৪ পাউন্ড ৫ সেন্টস পাবে।
তবে কিছুকিছু জবের ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকে ভিন্নতা দেখা যায়। কিছুটা পয়সা বেশি পাওয়া যায়। যেমন- ক্লিনিং, সিকিউরিটি, বেবি সিটিং, কেয়ারিং, ক্যাবিং ইত্যাদি।
কিন্তু যারা পড়াশোনার পাশাপাশি জবের চিন্তা নিয়ে আসবেন তাদের বলছি, সব ধরনের কাজ করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে এবং মনমানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
আরেকটি কথা যেটা জানা খুবই জরুরি সেটি হলো এইখানে ব্রিটিশ পাসপোর্ট হওয়ার আগ পযর্ন্ত আপনাকে বা আমাকে ‘ওড জব’ বা স্ট্রাগল করতেই হবে। আমরা কি পারি না আমাদের দেশের প্রত্যেকটি জবকে সম্মানের চোখে দেখতে!
ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী
ই-মেইল: topu1212@yahoo.com
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |