কুরআনের হারিয়ে যাওয়া শহরে বাঙালি

ইতিহাসের পিছু নিতে আমার মন্দ লাগে না। তাই মাঝেমাঝে ছুটে বেড়াই ঐতিহাসিক স্থানে।

মো. ফারুক হোসেন, ওমান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2017, 01:00 PM
Updated : 25 July 2017, 04:18 PM

এবার ছুটলাম আরবের ‘হারিয়ে যাওয়া শহর’ বা ‘আটলান্টিস অব দ্য স্যান্ডস’এর সন্ধানে। সেমেটিক ধর্ম বিশেষত ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মগ্রন্থগুলোতে এ শহরের নাম ঘুরেফিরে এসেছে।

সুগন্ধি বৃক্ষ ফ্রাঙ্কেনসেন্স

হারিয়ে যাওয়া শহরটি ছিল তখনকার সবচেয়ে চাকচিক্যময় ও আধুনিক শহর। ধর্মগ্রন্থগুলো বলছে, সেই শহরের মত শক্তিশালী বাড়ি-ঘর এর আগে কেউ কখনো দেখেনি বা নির্মাণ করেনি।

শহরটি তৈরি হয়েছিলো উঁচু উঁচু পিলার দিয়ে, যা তখনকার দিনে ছিল কল্পনাতীত অবকাঠামো।

এছাড়া এটি ছিল বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি। এখানে সুগন্ধি গাছ ‘ফ্রাঙ্কেনসেন্স’ এর চাষাবাদ হতো। সোনার চেয়েও দামি এ ‘ফ্রাঙ্কেনসেন্স’ সমুদ্রপথে জাহাজে করে রপ্তানি হতো। আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এরকম সুগন্ধি গাছ আরবের আর কোথাও জন্মাতো না।

হারিয়ে যাওয়া এ শহরটি ‘উবার’(Ubar), ওয়াবার (Wabar) কিংবা ‘ইরাম’ (Iram) নামে পরিচিত। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনে আমরা আরবের হারিয়ে যাওয়া শহরটি ‘ইরাম’ নামে পাই।

হারানো শহর উবার বা ইরামের কাল্পনিক নকশা

যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ‘আদ’ সম্প্রদায় বাস করত। সুরা আল ফজরের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে ‘ইরাম’ শহরের কথা রয়েছে। এখানে স্বয়ং আল্লাহ তার শেষ নবীকে ‘আদ’ বংশের শৌর্য-বীর্য সম্পর্কে বলেছেন।

১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে‘দ্য লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস’ পত্রিকায় জানানো হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আবিষ্কার হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস ক্লাপের উদ্যোগে প্রাচীন মানচিত্র ঘেঁটে এবং মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’র  স্যাটেলাইটের সাহায্যে খুঁজে পাওয়া যায় ১২ মিটার বালির নিচে লুকিয়ে থাকা ‘ইরাম’ বা ‘উবার’ শহরকে।

শহরটি ওমানের মাস্কাট থেকে ৯০০ কিমি দূরে শিসর এলাকায় অবস্থিত। যা ওমানের ধোফার প্রদেশে পড়েছে। উবার শহরটি ‘রুব-আল খালি’ মরুভূমির নিচে চাপা পরে আছে, যা ‘মরুভূমির জনশূন্য’ এলাকা বলে পরিচিত।

সুগন্ধি বৃক্ষ ফ্রাঙ্কেনসেন্স

সালালা থেকে ১৭০ কিমি উত্তরে ড্রাইভ করে আমি পৌঁছে যাই উবার শহরে। সালালাতে তখন বর্ষাকাল, যা স্থানীয়রা ‘খারিফ’ নামে চেনে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য গরমে অস্থির। আর সালালাতে বইছে হিমেল বাতাস।

তাই পর্যটকদের ভিড়ে সালালা’র রমরমা অবস্থা। পর্যটকরা যখন সালালার খারিফ মৌসুমের প্রেমে বুদ হয়ে আছে, তখন আমি উবার শহরের খোঁজে।

উবার শহরে খারিফের ছিটেফোঁটাও পেলাম না। বরং মাস্কাটের মতই গরম অনুভূত হল। স্রষ্টার অভিশাপ যেন এখনো বলবত আছে। উবার শহরে প্রবেশ মুখেই পেলাম লাল রঙ্গের নোটিশবোর্ড। যেখানে শহরের নাম আর এটা যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত সে বিষয়ে লেখা।

বিলবোর্ড পেরিয়েই চোখে পরল এক মৃতপ্রায় ফ্রাঙ্কেনসেন্স বৃক্ষ। এই গাছের সুগন্ধি রপ্তানি করেই একসময় ফুলেফেঁপে উঠেছিল ওমানের অর্থনীতি। যদিও তেলই বর্তমান ওমানের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তবে এখনো সালালার স্থানীয় আয়ের মূল উৎস এই সুগন্ধি।

লেখকের হাতে সুগন্ধি ফ্রাঙ্কেনসেন্স

এলাকার খোলা বাজারগুলো গোলাপজল, চন্দন, ধূপধুনো আর আগরের গন্ধে ভরপুর। বিশ্বের পারফিউমের রাজধানী এই সালালা। সব নামিদামি ডিজাইনাররা সুগন্ধি সংগ্রহের আশায় এখানে ছুটে আসে।

সুগন্ধির জন্য প্রসিদ্ধ উবারে উত্তর দিক থেকে জর্ডান ও তুর্কি এবং পশ্চিম দিকের সুদূর আফ্রিকা থেকে বাণিজ্য জাহাজ আসতো।

তবে কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়ায় স্থলভূমির রাস্তা ‘দ্য ইনসেন্স রোড’। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষগুলো থেকে রাস্তাটার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। সহস্র পিলারের শহরটার গোড়াপত্তন করেছিল নূহ (আঃ) এর বংশধরেরা। মরুভূমির কাফেলাগুলোকে পানি সরবরাহ করে ধনী হয়ে উঠেছিল শহরটি।পানির সেই কূপটি এখন বিশাল এক পাথরচাপা পরে আছে। পাথরের একদিকে বর্তমানে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে আমি ভেতর পর্যন্ত গিয়েছিলাম।

সেখানে বেশ অন্ধকার আর পোকা-মাকড়ের শব্দ। অক্সিজেনেরও ঘাটতি আছে মনে হল। ভেতরে আরেকটি ছোট গর্ত দেখলাম। সেখান দিয়েও হয়ত নিচে নামা যায়। তবে অন্ধকার আর পোকা-মাকড়ের বিকট শব্দে ভেতরে যাবার আর সাহস হল না। এছাড়া মরুভূমির বিষাক্ত সাপের কথাও মাথায় আসছিল।

আমি একটা মৃত শহরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে পোকামাকড় ছাড়া জীবনের আর কোনও স্পন্দন পাওয়া যায় না। অথচ এখানেই ছিল আরবের সবচেয়ে আধুনিক শহর ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত জীবনের কোলাহল। সুউচ্চ পিলার দিয়ে নির্মিত শহর ‘আদ’ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা অনেক জোরদার করেছিল।

এমন পিলার দিয়ে কোন শহর হতে পারে- তখন কেউ এটা কল্পনাও করেনি। হয়ত অনেকেই এই সুউচ্চ পিলার, যা তাদের নিরাপত্তা দিত; তাকে পূজো করা শুরু করে। এছাড়া বেদুঈনদের বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা তো ছিলই।

কুরআন শরিফ মোতাবেক নবী হুদ (আঃ) এই আদ সম্প্রদায়কে দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু অধিকাংশ আদ সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে থাকার গর্বে নবীকে তাচ্ছিল্যের সাথে বিদায় করে। কেউ কেউ আবার নবীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়,‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’? (সুরা: হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)

ফলে প্রাথমিক ‘গযব’ হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর শহরে বৃষ্টি বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত শুকিয়ে বালুময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায় এবং সবশেষে নেমে আসে ভয়াবহ ‘আযাব’।

সূরা হা-ক্বক্বাহ ৭-৮ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,‘তাদের (আদ সম্প্রদায়) উপরে প্রচণ্ড ঝড়ের বাতাস বয়েছিলো টানা সাত রাত ও আট দিন। (হে মুহাম্মাদ!) তুমি দেখলে দেখতে পেতে যে, তারা অসার খেজুর গাছের কাণ্ডের মতো মাটিতে পড়ে রয়েছে। তুমি (এখন) তাদের কোনও অস্তিত্ব দেখতে পাও কি?’

কুরআন শরীফ অনুসারে এভাবেই আদ সম্প্রদায় ও তাদের শহর উবার বা ইরাম শহর বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং চিরতরে বালিতে চাপা পরে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে মরুভূমির মাঝে কী করে সুউচ্চ পিলার নির্মাণ করা হলো? বালির মাঝে পিলার নির্মাণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই উবার বা ইরাম শহর মোটেও মরুভূমির মাঝে ছিল বলে মনে হয় না।

যদিও অনেকেই ব্যাখ্যা করে থাকেন মরুভূমির মাঝেই এই ‘ইরাম অব পিলার’ শহরটি গড়ে উঠেছিল। তবে কুরআন শরিফেও বলা আছে ইরাম শহর ছিল সবুজ শ্যামল। মরুভূমি নিশ্চয়ই সবুজ শ্যামল হতে পারে না।

বিজ্ঞানও কিন্তু এ বিষয়ে একমত। এই মরুভূমি কিন্তু আজীবন এমন মরুভূমি ছিল না। বরং এখানে ছিল নদী, লেক আর ঝর্ণা। প্রাণের হৈ-হুল্লোরে ভরপুর ছিল এই মরুভূমি। বিজ্ঞানের মতে মিলানকোভিচ ও অরবিটাল ফোর্সিং-এর কারণে মরুকরণের জন্ম। সহজ সরল ভাষায় বলতে গেলে পৃথিবী তার আপন কক্ষপথে ঘূর্ণনের সময় মাঝেমাঝে আমাদের মত হোঁচট খায় (আচমকা কম্পন)। এর ফলেই আবহাওয়ার অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে এবং শুরু হয় মরুকরণ।

বর্তমানে নবী হুদ (আঃ) এর শেষ ঠিকানা সালালা শহর থেকে প্রায় ১৭০ কিমি দূরে হাসিক ও সাদাহ  শহরের কাছের এলাকায়। ধোফার পাহাড়ে এখনো কিছু আরব বেদুঈনের গোত্র আছে, যারা নিজেদের উবারের রাজার বংশধর হিসেবে দাবি করে এবং তারা আরবের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চারণে কথা বলে থাকে। তাই  ‘রুব-আল খালি’ মরুভূমিতেই যে উবার বা ইরাম শহর লুকিয়ে আছে এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

অনেক আরবিয় ব্যাক্তিদের ধারণা ইরাম বা উবার শহরে অনেক দুষ্ট জ্বিনকে আটকে রাখা হয়েছে। এ শহরকে খনন করে বের করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ দুষ্ট জ্বিনগুলো এতে মুক্তি পেয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলেন বাদশাহ শাদ্দাদ পৃথিবীর বুকে জান্নাত তৈরি করেছিলেন যার নাম ছিল ‘ইরাম’ বা ‘আরাম’ বা ‘উবার’। সেই জান্নাত স্রষ্টার অভিশাপে বালির নিচে চিরতরে হারিয়ে গেছে।

উবার শহর থেকে ফেরার পথে বর্তমান ফ্রাঙ্কেনসেন্স পার্কে যাই। সেখানে দেখা পাই অসংখ্য সুগন্ধি গাছের। কিছু সুগন্ধি হাতের মুঠোবন্ধী করি। মনে হয় যেন সহস্র বছর আগের হারিয়ে যাওয়া ইরাম বা উবার শহরের গন্ধ গায়ে মেখে পথ চলছি।

লেখক: হেড অব মার্কেটিং, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!