মধ্যপ্রাচ্যনামা: ভিনদেশে নিজের দেশের মানুষ পাওয়ার আনন্দ!

নেপালি গাড়িচালক রানার হাতের প্ল্যাকার্ডে আমার নাম দেখে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, “সম্ভবত আপনি রানা, তাই না?”

মো. রায়হান হোসেন, ওমান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2017, 06:04 AM
Updated : 25 July 2017, 10:10 AM

আমি মনে মনে ভাবছি, সে কি বুঝতে পারল নাকি হিন্দিতে আবার বলতে হবে? সে যদি হিন্দি শুরু করে, তাও কিঞ্চিত রক্ষা। কারণ বাংলা শব্দের কিছু আকার-ওকার বাদ দিলে আর হাল্কা জোড়াতালি দিয়ে দু-চারটা হিন্দি শব্দ জন্ম দেওয়াটা অতোটা কঠিন কাজ না। তবে যদি সে নেপালি শুরু করে, তাহলে- আল্লাহ মালুম! 

উত্তরে রানা বললো, “হ্যালো ডক্টর, হাউ আর ইউ? ওয়েলকাম টু ওমান।” এমন সাবলীলভাবে একগাল হেসে, এতো আন্তরিকতার সাথে বললো যেন একবারের জন্য আমার মনে হলো আমি কী ওমান আসলাম নাকি নেপালে! 

সাবলীলভাবে ইংরেজিতে পুরো বাক্য বলতে পারাতে বোঝা গেল তার ইংরেজির ওপর দখল বেশ ভালো, যা আমাদের অনেকের মাঝেই বিরল। হাজার হাজার সার্টিফিকেটধারী বাঙালি এখানে কাজ করে অল্প বেতনে, অথচ একই যোগ্যতা নিয়ে ভারতীয় আর ফিলিপিনোরা কাজ পায় তিনগুণ বেশি বেতনে শুধুমাত্র ইংরেজিতে একটু ভাল দখল থাকার জন্য। যাই হোক, এসব কথায় আসবো আরেকদিন।

আমার সিম কার্ড কিনতে হবে, ভালোভাবে পৌঁছেছি সেই খবর দিয়ে চিন্তাটা কমিয়ে মায়ের মনকে শান্ত করতে হবে। রানা ছেলেটাকে খুব আন্তরিক মনে হল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,কোন সিমকার্ড কিনবো?

জবাবে সে বললো, “ডক্টর ইউ ক্যান বাই এনি ওয়ান ফ্রম ওমানটেল, নওরাজ, রেন্না অর ফ্রেন্ডি।” এইসব কোম্পানির নাম শুনে গ্রামীণ ফোন ,বাংলালিংক আর এয়ারটেল নামক মোবাইল কোম্পানিদের এই প্রথমবারের মতো মিস করলাম। 

সিমের দোকানে এসেছি, তখন এক ওমানি দোকানদার বলছে, “গিব বাসবোর্ড।” আমি অসহায়ের মতো রানার দিকে তাকিয়ে আছি। রানা বললো, “ডক্টর, হি ওয়ান্টস ইওর পাসপোর্ট।” ওরা নাকি ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না কারণ আরবিতে ‘প’ অথবা ‘p’ এই শব্দ নাই। পাসপোর্ট দিয়ে মনে মনে ভাবছি, আরবি তো কিছুই পারি না, কপালে জানি কী আছে আরও। 

দুই রিয়েল দিয়ে একটা ওমানটেল সিম কিনলাম, সাথে দুই রিয়েলের টক টাইম, ইন্টারনেট কানেকশনের জন্য আরও তিন রিয়েল নিল। সব মিলিয়ে পাঁচ রিয়াল, এর মানে হল বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫০ টাকা, যা দিয়ে পেলাম মাত্র পাঁচশ’ এমবি ইন্টারনেট আর প্রতি মিনিট ৭ টাকা ন্যাশনাল কল রেট।

বুঝলাম,ওমানি রিয়াল আর আর বাংলাদেশি টাকার ২১০ গুণ পার্থক্যের হিসেব-নিকেশই এখন থেকে মোবাইলের মূল ব্যবহার, কথা বলা নয়। সবসময় বলতাম গ্রামীণ ফোন সবকিছুতে এতো টাকা নেয় কেন! এখন গ্রামীণ ফোনকে ধন্যবাদ দিতে মন চাচ্ছে, কমই তো নিতো। 

লাগেজ নিয়ে এবার থাকার জায়গার দিকে যাত্রা শুরু। ঢাকা শহরে ২০ কিলোমিটার গতিতে চলে অভ্যস্থ কেউ যখন জ্যামহীন কোনো শহরে একশ’ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলে, তখন সেই ছুটে চলার আনন্দটি একটু বেশিই। চোখ মেলে তাকিয়ে যখন সাজানো-গোছানো পরিপাটি চারপাশ দেখি, তখন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে মন চায়। 

সারিবদ্ধভাবে সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া চারদিক, তার মাঝে খেঁজুর গাছের সারি। থোকায় থোকায় খেঁজুর ধরে আছে তাতে, একেক গাছে এক এক ধরনের খেঁজুর। কতক গোল, কতক আবার লম্বাটে। নিশ্চয়ই তাদের আলাদা নামে ডাকা হয়, নামগুলো পরে জেনে নিতে হবে।

দুই- চারটা বোতল ব্রাসের গাছও চোখে পড়লো, সেই সব ঘাস আর গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে রয়েছে ফোয়ারার মতো করে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা। এই পানির ফোয়ারাতে ঘাসের ওপর ভিজতে মন চায়। 

জ্যাম আর কোলাহলবিহীন ছিমছাম শহরের কানায় কানায় সৌন্দর্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। বেশিক্ষণ সেই সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ হল না, এরই মধ্যে পৌঁছে গেলাম।

রানা বিদায় নেওয়ার আগে রবি নামে এক বাঙালি গাড়িচালকের মোবাইল নাম্বার দিয়ে বললো,প্রয়োজনে যেন তার সাথে যোগাযোগ করি। 

লম্বা শাওয়ার শেষ করে বাবাকে জানালাম, আমি পৌঁছে গেছি। মায়ের শুধু পৌঁছানোর খবরে শুনে মন ভরে না, তার সন্তান খেয়েছে কিনা সেটাও জানতে হয়। সেজন্যই সমস্ত পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ভালবাসার নাম ‘মা’।

পড়ন্ত বিকালে দুপুরের আহার সারার প্রয়াসে দুই কদম হেঁটে চলা পথেই এক টার্কিশ রেস্টুরেন্টের দেখা মিললো। রেস্টুরেন্টের বাইরের অংশে খোলা আকাশে চমৎকার নকশা করা ছাতার নীচে বসার ব্যবস্থা আর ভেতরের অংশে নানা কারুকাজে মোড়া, যার প্রতি ইঞ্চিতে সৌখিনতার ছোঁয়া। নাম ‘আল মাওয়ালেহ টার্কিশ রেস্টুরেন্ট’। 

নানা ধরনের আকর্ষণীয় খাবারের তালিকায় চোখে বুলাতে বুলাতে কাঁচের ভেতরে থাকা কয়েক ধরনের ফ্রেশ সি ফিশের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। এর মধ্যে শায়রি আর কিং ফিশ নাকি এখানকার সকলের প্রিয়।

ওয়েটারদের মধ্যে বেশিরভাগই সাদা চামড়ার দেখে মনে হলো, হয় তারা টার্কিশ আর তা না হলে ইজিপশিয়ান। মিশরীয়রা সুদীর্ঘ আর পরিপূর্ণ সুঠামদেহী, এদেরকে ওমানিদের থেকে সহজেই আলাদা করা যায় দেহের গঠন আর পড়নের পোশাক দেখে। এরা ওমানিদের মতো পোশাক পরে না, বেশিরভাগই শার্ট-প্যান্ট পড়ে। টার্কিশরা দেখতে ইজিপশিয়ানদের থেকে কিঞ্চিত খাটো। গড়নও তুলনামূলক স্লিম, অনেকটাই ইউরোপিয়ানদের মতো, কিন্তু কথা বলে আরবিতে। অতএব বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।

এরা বেশিরভাগই অল্প বিস্তর ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। ব্রিটিশ, অ্যামেরিকান আর অস্ট্রেলিয়ান ইরেজির পর এ আরেক ইংরেজি যার নাম অ্যারাবিক ইংরেজি। অ্যারাবিক ইংরেজির অবস্থা আমার অ্যারাবিকের মতো, সে নিয়ে আরেকদিন কথা হবে।

এতসব ওয়েটারদের মধ্যে একজনের চেহারায় বাঙালি-ভারতীয় ছাপের সংমিশ্রণ। সে কোন দেশের সেটা নিশ্চত হবার জন্য কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করায় যখন উত্তরে বললো বাঙালি, মনে হলো এ পরিচয়টাই শোনার জন্য এ হৃদয় আকুল হয়ে ছিল। জানলাম তার নাম রেজাউল, দেশের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। 

দূর দেশে এভাবে যখন বাঙালির সাথে বাঙালির দেখা হয়, তখন বাংলা ভাষায় কথা বলার আসল স্বাদ অনুভব করা যায়, এ স্বাদ যেন স্বর্গীয়!

বাঙালির সাথে বাঙালির দেখা হওয়া মানে খোশগল্পের আসর, সে আসরে সুখ-দুঃখের কথা হয়, হয় দেশে ফেলে আসা প্রিয়জনদের নিয়ে স্মৃতিচারণ। সেই সব গল্পের প্রতি পাতায় পাতায় থাকে দেশপ্রেমের ছোঁয়া, আমি এখন সেই গল্পের গভীরে যাচ্ছি না, অনেক ক্ষুধার্থ আমি। রেজাউল ভাইকে কিং ফিশটা দেখিয়ে ফ্রাই করে আমার ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করতে বললাম। 

আমার ঠিক সামনের টেবিলে এক ওমানি পরিবার বসে আছে। স্বামী-স্ত্রী খুব যত্ন করে তাদের আদরের পরীর মতো দেখতে বাচ্চা মেয়েটাকে খাইয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীর সব সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে সুন্দর, একটা সুন্দর পরিবারের থেকে চমৎকার আর কিছুই হতে পারে না। আমি আমার পরিবারের সবাইকে নীরবে আরও একবার মিস করলাম।

মিনিট দশেকের মধ্যে আমার টেবিল জুড়ে টার্কিশ স্পেশাল রুটি আর কিং ফিশ ফ্রাইয়ের আবির্ভাব। প্রেমে পড়াটা মানুষের সহজাত স্বভাব, কিন্তু সেটা যদি হয় কিং ফিশের প্রতি প্রেম, সেই প্রেম হয়ত কিঞ্চিত বেমানান। এমন বেমানান প্রেমেই মজলো আমার মন, এ স্বাদ ভোলার নয়। 

পরবর্তী লেখায় সেই প্রেমের আদ্যপান্ত শোনাবো।

(চলবে)

লেখক: মেডিকেল অফিসার, রিনাইসেন্স পিএসি ক্লিনিক, ওমান

ই-মেইল: dr.mrhossain87@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!