নিউ ইয়র্ক ও আমাদের হুমায়ূন স্যার

জ্যামাইকার টাস্কিগি এয়ারম্যান ওয়ে’র বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তাকে ফোন করলাম। তিনি ফোন ধরে হেসে বললেন, “চলে এসেছেন? আপনি ভেতরে চলে আসুন। আমি তৈরি হচ্ছি। খুব বেশি সময় লাগবে না।”

শামীম আল আমিন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2017, 05:16 AM
Updated : 25 July 2017, 05:18 AM

আমি বললাম, “কোনো অসুবিধা নেই। আমি গাড়িতেই অপেক্ষা করছি।”

এরপর অবশ্য খুব বেশি সময় নিলেন না মেহের আফরোজ শাওন। নেমে এসে হাসি মুখে উঠে বসলেন আমার গাড়িতে। গাড়িও চলতে শুরু করেছে।

মে মাসে নিউ ইয়র্কে খুব বেশি গরম পড়ে না। কিন্তু আজকের দিনটায় মনে হচ্ছে আগুন ধরছে। বিশেষ করে সূর্যের তেজটা বড্ড বেশি। শাড়ির সাথে তাই খুব বেশি কিছু পড়তে হলো না শাওনকে। বরং গরম কমাতে বাড়িয়ে দিতে হলো এসিটা।

কিছুটা কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর আলোচনা আর এগুচ্ছে না। কারণ, কী বলবো, কোথা থেকে শুরু করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। নিরবতা ভেঙে আমিই বললাম, “হুমায়ুন মেলা তো বেশ হয়েছে এবার। আপনি কি বলেন?”

“হ্যাঁ, খুবই ভালো হয়েছে। প্রথম আয়োজন, এতটা ভালো হবে, আশাই করা যায় না। বিশেষ করে, এতো মানুষ সেমিনারের আলোচনা শুনেছে। আমি তো অবাক! আর আপনিও উপস্থাপনা ভালো করেছেন।”

নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলাম। প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম, “আসলে সবাই এসেছিলেন হুমায়ুন স্যার সম্পর্কে জানতে। তার ছিল তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা।” এ পর্যায়ে শাওন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। তাকালেন বাইরে। কিছু একটা কি খুঁজছেন!

প্রথমবারের মতো ‘হুমায়ূন মেলা’ হয়েছে নিউ ইয়র্কে। তাতে মানুষের বাঁধ ভেঙেছিল। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও তার প্রিয় গান গেয়ে শুনিয়েছেন জনপ্রিয় শিল্পীরা। ছিল তাঁর লেখা বইসহ দেশিয় নানা পণ্যের পসরা। হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব হয়ে উঠেছিল ‘হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে মধ্যবিত্ত জীবন’ শীর্ষক একটি সেমিনার। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। ছিলেন নিউ ইয়র্কের বিশিষ্টজনেরা। সেই সেমিনারটির সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল আমার।

মেহের আফরোজ শাওন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখলেও, সেমিনারে তিনি ছিলেন কেবলই শ্রোতা। কথা শুনতে শুনতে বার বারই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন তিনি; হয়ে পড়ছিলেন অশ্রুসজল। মঞ্চ থেকে সেই দৃশ্য আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।

সেমিনার হলে কী হবে, মানুষের যেন ঢল নেমেছিল। বসতে দেওয়ার জায়গা নেই। দাঁড়িয়েই সেমিনারের বক্তব্য শুনছে মানুষ। আসলে তারা শুনছে কিংবদন্তি হুমায়ুন আহমেদের কথা।

এরই মধ্যে গাড়ি চলতে চলতে আলোচনা জমে উঠলো। শাওন কথা বললেন নানা প্রসঙ্গে। খুব গুছিয়ে কথা বলেন। শুনতে ভালো লাগে। এর মধ্যে একবার এক্সিট মিস করে অন্য পথে উঠে গেলাম। তাতে অবশ্য কোনো বিরক্তি প্রকাশ করলেন না তিনি।

কিছুটা বেশি সময় লাগলেও, ঠিকঠাকই ‘টিবিএন২৪ টেলিভিশন’-এর উডসাইড অফিসে পৌঁছে গেলাম আমরা। একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি।

নিউ ইয়র্কের অত্যন্ত জনপ্রিয় টেলিভিশন ‘টিবিএন২৪’। আর এই টেলিভিশনের হেড অব নিউজ আমি। বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে অনেক কাজই করতে হয়। সেই সাথে নিউজ পড়ি, টক শো করি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি। মেহের আফরোজ শাওনের বিশেষ সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্বও আমার কাঁধে। আর অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমাদের হুমায়ূন স্যার’।

মেহের আফরোজ শাওন নিজেই একজন খ্যাতিমান মানুষ। গুণী অভিনেত্রী, সঙ্গীত শিল্পী। বিটিভির স্বর্ণযুগে নতুন কুঁড়িতে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। তার সম্পর্কেই জানার আছে অনেক কিছু। আমি তাঁকে বিনীত ভঙ্গিতে জানালাম, আজ কেবল হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কেই জানতে চাইবো। কারণ তাঁর মতো করে, এই কিংবদন্তি সম্পর্কে বলার মানুষ কোথায়! তাই জানার আছে অনেক কিছুই।

শাওন হেসে বললেন, “অবশ্যই।” জানিয়ে দিলেন, কোনো প্রশ্ন করতেই যেন দ্বিধা না করি। অনুষ্ঠান শুরু হলো। সাবলিল ভঙ্গিতে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে জানা-অজানা নানা তুথ্য তুলে ধরলেন। তবে এই লেখায় অনেকদিন পরে হুমায়ূন আহমেদকে ছাড়া নিউ ইয়র্কে এসে শাওনের কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সে কথাই কেবল জানাবো পাঠকদের।

২০১২ সালের ১৯ জুলাই। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি শোকের। সেদিনই নিউ ইয়র্কে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে করতে শেষ পর্যন্ত হেরে যান কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার কিছুদিন পরে মরদেহ নিয়ে দেশে ফেরেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তার আগে দুই শিশু পুত্র নিষাদ আর নিনিতকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে রীতিমতো যুদ্ধই করতে হয়েছে তাঁকে।

দেশে ফেরার পর পেরিয়ে গেছে হুমায়ূন আহমেদহীন পাঁচটি বছর। এতদিন পরে আবারও এলেন, সেই নিউ ইয়র্কে। চারিদিকে অদ্ভুত শূন্যতা। এই শূন্যতার অনভূতি কী? মেহের আফরোজ শাওনের কাছে এটাই ছিল আমার প্রথম প্রশ্ন।

সব অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পারে না মানুষ। যথাযথ হয় না। এরপরও উত্তর দিলেন তিনি। শাওন বলছিলেন-“এই শহরটার সাথে না আমার অন্যরকম সম্পর্ক। খুব ভাবের একটা সম্পর্ক আছে। আবার খুব অভিমানের সম্পর্ক। ভাবের সম্পর্কের কথা আগে বলি। নিউ ইয়র্কে আমি অনেকবারই এসেছি। বেড়াতে এসেছি, অনুষ্ঠান করতে এসেছি। কিন্তু ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে একটা যুদ্ধ করার জন্যে এসেছিলাম। হুমায়ুন আহমেদের শরীরে বাসা বাঁধে কক্রট ব্যাধি; যুদ্ধটা ছিল সেই ব্যাধির সঙ্গে। তখন আমার কনিষ্ঠ পুত্রের বয়স ছিল ১ বছর ৭ মাস। একটা নতুন সংসার গড়ে তুলি এই নিউ ইয়র্কে। হুমায়ুন আহমেদ যে সংসারের কথা তাঁর নিউ ইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ বইতে লিখেছেন।”

এ পর্যন্ত বলে শাওন যেন একটু দম নেওয়ার চেষ্টা করেন। সামান্য একটু বিরতি নিয়ে আবারও বলতে শুরু করেন, “সেই যুদ্ধের মধ্যেও আমাদের চারজন মানুষের সংসারটা অনেক সুন্দর ছিল। অনেক আবেগের ছিল। অনেক পাওয়ার ছিল। আমার সংসার জীবনে বাংলাদেশে যখন একজন লেখক হুমায়ুন আহমেদকে পেয়েছি, তখন সেই সংসারে অনেক কাজ, লেখা, অনেক প্রকাশকের আনাগোনা, বিভিন্ন শুটিংয়ের কারণে তাঁর শত ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ত জীবন থেকে হঠাৎ করে আমরা যখন নিউ ইয়র্কে আমাদের নতুন সংসার জীবন শুরু করলাম, সেখানে আমাদের একটাই ব্যস্ততা, সেটা হচ্ছে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ। এর বাইরে যে সময়টুকু ছিল, তা একান্তই আমাদের চারজনের।”

শাওন বলে চলেন। আমি মন দিয়ে শুনি- “আমার মনে হয় না আর কখনও আমার বাচ্চারা এমনভাবে তাদের বাবাকে পেয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ একজন বাবা হিসেবে, পরিবারের প্রধান হিসেবে যে কতোটা অসাধারণ মানুষ ছিলেন, তা এই সময়ে যারা হুমায়ুন আহমেদকে দেখেছেন, তারাই বলতে পারবেন। অসম্ভব সুন্দর কিছু মুহূর্ত আমরা কাটিয়েছি এই নিউ ইয়র্কে। যে কারণে আমি বলবো, নিউ ইয়র্কের সাথে আমার একটা ভাব। আর নিউ ইয়র্কের প্রতি আমার অনেক অভিমান। নিউ ইয়র্ক আমাকে যতটুকুন দিয়েছে সেই ছোট্ট সংসারে, আমি বলবো, সাময়িক সংসারে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে অনেক কিছু, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আমি হারিয়েছে এই নিউ ইয়র্কে। আর সেই অভিমানটুকু ধরে রেখে আসতে পারিনি এতদিন।”

এটা সেই শহর, যে শহর দেওয়া আর নেওয়ার অদ্ভূত এক রহস্যময়তায় জড়িয়ে রেখেছে শাওন ও তার দুই শিশু পুত্রকে। বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করা কঠিন। এরপরও জানতে চাইলাম, কী ভেবে অভিমানগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখলেন?

মেহের আফরোজ উত্তর দিলেন, “আমার বড় পুত্র নিষাদ হুমায়ুন, ওর স্মৃতিগুলো একদম দগদগে। নিষাদ প্রতি বছরই বলতো, মা আমরা আবার কবে যাব নিউ ইয়র্কে? ওর বলার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। তার স্মৃতি একরকম, আর আমার স্মৃতিগুলো অন্যরকম।”

শাওন বললেন, “আমরা শেষের দিকে যে বাসাটায় থাকতাম, সেই  বাসাটার পেছনে এক টুকরো ব্যাকইয়ার্ড ছিল। হুমায়ুন আহমেদ করতেন কি, নিষাদকে নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে গাছ লাগাতেন। সেটা ছিল ২০১২ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিককার কথা। তারা আমাদের দেশিয় কিছু গাছ লাগিয়েছিলেন। শিম গাছ, লাউ গাছ। পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে সেই গাছগুলোর পরিচর্যাও করতেন। নিষাদ এসব মনে করে নিউ ইয়র্কে খুব আসতে চাইতো। বলতো সেই গাছ দেখতে চাই, সেই বাড়িটা দেখতে চাই। বেলভিউ হাসপাতালটা দেখতে চাই।”

“আমাদের বিকালটা কাটতো পিআর সেভেনটিনে। নদীর ধারে ওই জায়গাটা হুমায়ূন আহমেদের অনেক প্রিয় ছিল। প্রায়ই বিকেল হলে তিনি বলতেন, আমাকে সেখানে নিয়ে চলো। বাচ্চারা আনন্দ করবে এবং তিনি আনন্দ দেখবেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে আমি আমার ভাবের শহরে এসেছি। আমার হৃদয়ের টুকরো অংশগুলো যে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলো আমি একটু একটু করে সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। সেগুলো আমি আমার কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।”

হুমায়ূন আহমেদ ও শাওন দম্পতির দুই শিশুপুত্র নিষাদ-নিনিত। নিউ ইয়র্কে এসে তাদের শিশুমন কী ভাবছে? তারা কি নিজেদের সব অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে? কেমন লাগছে তাদের?

শাওন জানালেন, “নিষাদের স্মৃতিগুলো এখনও অনেকটাই আছে। প্রবলভাবেই আছে। সে মনে করতে পারছে অনেক কিছুই। ও ঢাকা থেকে অনেক প্ল্যান করেই এসেছে। বিশেষ করে কোন জায়গাগুলোতে সে যেতে চায়। আর আমার ছোট ছেলে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছে। ও তার বড় ভাইকে ডাকে ‘আইয়া বাবা’ বলে। আইয়া মানে ভাইয়ার একটা অংশ। আর বাবাতো বাবাই। আমার বড় পুত্র ছোট পুত্রকে সবসময়ই বলে, বাবার কাছে তুমি যা কিছু চাইতে, সেইসব আমার কাছে চাইবে।”

“নিনিত তার আইয়া বাবার কাছ থেকে যা কিছু শুনেছে, তারই কিছু ধারণা রয়েছে মনে। নিনিত বলে, আমার তো কিছু মনে নেই। ও দেখছে নতুন পর্যটকের দৃষ্টিতে। আমি আর নিষাদ দেখছি স্মৃতি বিজড়িত জায়গা হিসেবে। একটা কথা এখনো মনে পড়ে, হুমায়ূন আহমেদ কিভাবে সিগেরেট ছেড়ে দিলেন। ক্যান্সার হবার সাথে সাথেই কিন্তু তিনি সিগেরেট ছেড়ে দিতে পারেননি। আমার ছোট পুত্র তখনও হাঁটতে শেখেনি। এই নিউ ইয়র্কে প্রথম যেদিন সে হেঁটে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো, সেদিন তিনি ঘোষণা দিলেন- এখন আমার সময় এসেছে সিগেরেটকে বিদায় জানানোর। অনেক অনেক স্মৃতি।”

হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে শাওন এমনভাবে বলছিলেন, যেন সবকিছু চোখের সামনে ভেসে উঠছে। চলচ্চিত্রের মতো। যেন সবকিছু দৃশ্যমান। তাই এবার জানতে চাইলাম, এই শহরে হুমায়ূন আহমেদের অস্তিত্ব কিভাবে টের পাচ্ছেন?

মেহের আফরোজ শাওন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব বেশি সময় নিলেন না। বললেন, “যে জায়গাগুলোতে আমরা আগে গিয়েছিলাম, সেই জায়গাগুলোতেই তো যাচ্ছি। ওইসব জায়গাতে তাঁর পয়ের চিহৃ রয়েছে; অস্তিত্ব মিশে আছে। দেখুন সবসময়ই হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সাথে থাকেন। কিন্তু নিউ ইয়র্কের সেইসব জায়গাগুলোতে তিনি যেন আরও বেশি করে আছেন। নিবীড়ভাবে আছেন। তার সেই হাসিগুলো, তার সেই কথাগুলো, তার সেই অভিমানগুলো, এখনো কানে বাজে। ওই সময়ে বলা হুমায়ুন আহমেদের কথাগুলো বার বারই মনে পড়ছে। যদিও তার কথাগুলো আমাদের কাছে সবসময়ই তাজা।”

“নিশাত যখন বলে, মা মনে আছে, একদিন বাবা এবং আমি ভুট্টা কিনেছিলাম। নিউ ইয়র্কের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ কর্ন সেদ্ধ খেতে খুব পছন্দ করতেন। কর্ন কেনা হতো, তা সেদ্ধ করে, বিকালবেলা বাবা ছেলে বারান্দায় বসে একসঙ্গে খেত। বারান্দাতো না, সিঁড়ির গোড়ার দিকে বসে খেতেন। দরজাটা খুলে দিলে, বিকেলের আলো আসতো। এই ব্যাপারটি নিষাদের মনে পড়ে গেল। এটা কিন্তু বাংলাদেশে কোনোদিন বলেনি। আমাদের কেবলই মনে হচ্ছে, হুমায়ুন আহমেদ আমাদের পাশেই আছেন।” কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন শাওন।

এরপর কথা হলো হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় নানা বিষয় নিয়ে; তাঁর লেখালেখি, সিনেমা-নাটক বানানো, হুমায়ূন আহমেদের গান, জ্যোৎস্না আর বৃষ্টি বন্দনা, হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি এক একটি চরিত্র হিমু, রুপা, মিসির আলী, শুভ্রদের কথা। রবীন্দ্রনাথ-হাছন রাজার গান, ভাটি অঞ্চল, নুহাশ পল্লী আর হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের কথা নিয়ে।

হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের জানা। আবার অনেক কিছুই জানা হলো মেহের আফরোজ শাওনের কাছ থেকে। কিন্তু সব কি জানা হলো! হয়তো হলো না। হয়তো অনেক কিছুই থেকে যাবে অজানা। হুমায়ূন আহমেদের অনেক অনুভূতি, চলে যাওয়ার সময় এই পৃথিবীর কাছে তার শেষ কথাটি কী ছিল, জানা হবে না। তবুও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন।

জানা হুমায়ূন, অজানা হুমায়ূন। কথায় কথায় সময় গড়িয়ে গেল দেড় ঘণ্টা। নিশ্চিতভাবেই জানি, আরও অনেক কথা বললেও হুমায়ূন আহমেদকে পুরোপুরি জানা হবে না। কিন্তু কোথাও না কোথাও থামতে হয়, তাই তখনকার মতো থামলাম।

তবে যাবার আগে আমার লেখা গল্পগ্রন্থ ‘বাক্সবন্দী মানুষ’ উপহার হিসেবে তুলে দিলাম শাওনের হাতে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রবাদপুরুষ হুমায়ূন আহমেদ; যার কারণে আমার ছেলেবেলার দিনগুলো ছিল রঙিন-বর্ণময়।

মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, বইটি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলাম আমি। তুচ্ছ লেখক শামীম আল আমিনের সেই আবেগের কথা জানানোর সৌভাগ্য হয়নি হুমায়ূন আহমেদকে। ‘অনন্যা’ থেকে প্রকাশিত বইটা যে কেবলই হুমায়ূন স্যারের জন্যে, অন্তত তাঁর সহধর্মিনী মেহের আফরোজ শাওন তো তা জানলেন।

এরপর প্রায় দুই মাসের সফর শেষে দেশে ফিরে যাচ্ছেন মেহের আফরোজ শাওন আর তার দুই পুত্র নিষাদ-নিনিত। কেমন গেল নিউ ইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে তাদের দিনগুলো? জানার জন্যে টেলিফোন করলাম।

ওপাশ থেকে ছোট্ট করে উত্তর দিলেন শাওন, “ভালো।” এরচেয়ে বেশি কিছু জানা হলো না। চেহারায় তখন কেমন অনুভূতি ফুটে উঠলো, দেখা হলো না। তিনি চলে গেলেন, হয়তো আবার ফিরবেন বলে।

শামীম আল আমিন: লেখক ও সাংবাদিক

ইমেইল: amin.one007@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: মেহের আফরোজ শাওন

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!