বাঙালি যখন পেরুর ইনকা সভ্যতায়

এ যেন এক রূপকথার গল্প। এক সময়ের রাজা, রানী, রাজকুমারী, রাজত্ব, প্রজা, সৈন্য, সেনাপতি এখন কল্পনার জগতে। আর ইতিহাস সে তো উপহাস, ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের ইতিকথা।

চিনু মৃধা, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 July 2017, 12:28 PM
Updated : 19 July 2017, 12:29 PM

পেরু থেকে ফিরেছি অনেকদিন হয়ে গেল। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে কতগুলো শব্দ- ইনকা, কেচুয়া, চিচা, কনকুবাই, পাচামামা, কুচকো, টেরাস ইরিগেশন, আরও কত কি!

অবশেষে সেই পাহাড়ি নদী উরাবাম্বা যা এখনো ধুকে ধুকে বইছে কখনো খরস্রোতা প্রতিবাদী, কখনও বা শান্ত হেরে যাওয়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সময়ের সাক্ষী ইতিহাস স্কন্ধে নিয়ে।

আজ থেকে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে পনেরশ’ শতাব্দী (১৪৩৮ - ১৫৭২) থেকে ষোলশ’ শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বত অঞ্চলে উরাবাম্বা নদীর উপত্যকায় আধুনিক কলম্বিয়া, এল সালভাদর, পেরু, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা এবং চিলি পর্যন্ত এ সভ্যতার ও সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ঘটেছিল।

ইতিহাসে এ সাম্রাজ্য প্রাক কলোম্বিয়াকালীন সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের একটি হিসেবে পরিচিত। সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কেন্দ্র আধুনিক দিনের পেরুর কুসকোতে অবস্থিত ছিল। আমরা সেই রূপকথার গল্পের দেশের রাজধানী কুসকোতে এসেছি। উদ্দেশ্য- ধবংস করে দেওয়া ইনকা সভ্যতার নিদর্শন দেখা।
ইনকা সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন মাচুপিচু দেখতে কুসকো থেকে ট্রেনে, সেই উরাবাম্বা নদীর পার ধরে কখনও বা নদীর উপর থেকে যাচ্ছি। হয়ত এই নদীই ছিল ওদের পথ দেখাতো, হয়ত এই নদীই ওদের জীবিকা এনে দিতো।

পাহাড় আর পাহাড়, কখন বা সরু ঝাউ গাছের নিরব কান্না। নদীর দুই পাশে পাহাড়ের ঢালে মাঝে মাঝে রয়েছে ইনকাদের পরিত্যক্ত চাষাবাদের নিদর্শন।

প্রায় চার ঘণ্টা পর ট্রেন এসে থামলো চারদিকে পাহাড় ঘেরা অপূর্ব সুন্দর এক পাহাড়তলিতে। তারপর মাইক্রোতে করে অনেকগুলো পাহাড়ের ঢাল আর ধাপ পেরিয়ে অবশেষে আমরা সেই ইনকা সভ্যতার অন্যতম গুপ্ত রাজপুরী মাচুপিচুতে পৌঁছলাম।

অদ্ভুত এ শহর। কুসকো থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে হুয়াইনাপিচু ও মাচুপিচু পাহাড়ে, প্রায় ৮ হাজার ফিট উঁচুতে অপূর্ব সুন্দর এ শহর। ধারণা করা হয় পনেরশ’ শতাব্দীতে তৈরি। ওপর থেকে মনোরম দৃশ্য, দুর্লভ দেয়াল, পাহাড়ের ঢালে চাষবাস ব্যবস্থার জন্য আজও এই শহরটি সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত।

প্রধান ভবন থেকে দেখা যায় পাহাড় ঘেঁষে পাঁচশ’ বছরের পুরাতন সেই ইনকা ট্রেইল যেটা শেষ হয়েছে রাজপুরীর সর্বোচ্চ পয়েন্ট ‘হাউজ অব দ্য গার্ডে’ এসে।

পাহাড়ের উপর এ পুরীতে ১৫০টিরও বেশি ভবন, যা সম্রাটদের ও অন্যান্য ইনকাদের থাকার ঘর, ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা পাঠাগার, সূর্য মন্দির, সেরিমনিয়াল সাইট, টেরাস চাষাবাদ ব্যবস্থা, টেরাস চাষাবাদের ধাপে ধাপে কৃষকদের থাকার ঘর, দূর পাহাড় থেকে ড্রেইন করে ১৬টি জলের কল, ফোয়ারা আরও কত কি! ধারণা করা হয়, সম্রাটরা বিশেষ বিশেষ কোনো উৎসব পালন করতে এখানে আসতেন।

কিন্তু রহস্য হলো এত আগে, পাহাড়ের এত উপরে- মেঘের দেশে, পাথর কেটে সিমেন্টের ব্যবহার ছাড়া আস্ত একটা নগরী ওরা কীভাবে বানালো তারা?

তখন তো লোহা অথবা চাকা চালিত যানবাহনের ব্যবহার ছিল না, কী করে ওরা এত উপরে সম্পূর্ণ একটি নগরী বানিয়ে ফেলেছিল? কেন এই রাজপুরী পরিত্যক্ত হয়েছিলো এখনও তা রহস্যজনক।

ধারণা করা হয়, ১৫৭২ সালে ইনকা সম্রাজ্যের পতনের পর এখানকার ইনকারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ইনকাদের সমাজ ব্যবস্থায় সবকিছুর মালিকানা ছিল রাষ্ট্রের। অনেকটা

ফিউডাল সমাজতন্ত্র-রাজতন্ত্রের মিশেল। সেই সমাজ ব্যবস্থায় সবাই কাজ করত। তাদের অর্থনীতি চলতো দ্রব্য পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে। কৃষি ছিল ইনকাদের আয়ের মূল উৎস, ইনকা সম্রাটরা কর হিসেবে সাধারণ জনগণের শ্রম গ্রহণ করতো। 

রাজতন্ত্র এইজন্য যে, ইনকা সম্রাটের ছেলেই সম্রাট হবার অধিকার রাখত। তবে জানা যায় অনেক সম্রাটদের কনকুবাইন বা রক্ষিতা থাকত। সম্রাট হবার অধিকার শুধু বৈধ স্ত্রীর পুত্রের থাকতো। 

ইনকারা প্রকৃতির উপাসক ছিল। তারা দাবি করত তারা সূর্য ও চন্দ্রের বংশধর। সূর্য তাদের পিতা ও চন্দ্র তাদের মাতা। তাই ইনকা সভ্যতার নিদর্শনগুলোতে অনেক সূর্য মন্দির, চন্দ্র মন্দির, রংধনু মন্দির ও বিদ্যুতের মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

ঘোর অমানিশা নেমে আসে ১৫২৭ সালে ইনকা সম্রাট হুয়াইনা কাপাকের মৃত্যুর পর। তার দুই পুত্র হুয়াস্কা ও আতাউল্পা মাঝে পাঁচ বছরের জন্য উত্তরাধিকার নিয়ে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়।

বারবার স্পানিশ আক্রমণেও সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পরে।

১৫৩৩ সালে,  স্পেনিস এক্সপেডিটর ফ্রাঞ্চিসকো পিজারো সর্বশেষ ইনকা সম্রাট আতাউল্পাকে পরাজিত ও হত্যা করে ইনকা সাম্রাজ্যকে স্পেনের কলোনি বানায়।  তখন থেকেই ইনকারা হারিয়ে যেতে থাকে। 

আর ১৫৩৭ সালে ইনকা সম্রাট হুয়ানা ক্যাপাকের তৃতীয় পুত্র মানকো অন্যান্য বংশধর এবং  ইনকা রিফুজিদের নিয়ে ভিলাকাবাম্বা নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে।

১৫৭২ স্পানিশরা সেই রাজ্যও দখল করে নেয়। শেষ শাসক মানকোপুত্র টিপাক অমুকে বন্দি করা হয় এবং মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এটা ছিল ইনকাদের শেষ প্রতিরোধ ও অস্তিত্ব। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ইনকাদের শেষ আশ্রয়।

দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার সেদিনও ছিল। ইনকাদের হত্যা করে, ধর্মান্তরিত করে সেদিনও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ওদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে। থেমে গিয়েছিল ওদের বাঁশির সুর আর রঙ-বেরঙ কাপড় পরিহিত পাহাড়ি নাচ।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল:  cdmridha@gmail.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!