মধ্যপ্রাচ্যনামা: একবার চোখ পড়লে মরণ ছাড়া গতি নেই!

ওমানে জেনারেল প্র্যাক্টিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি প্রায় বছর খানেক হল। এরই মধ্যে প্রায় ১৩ দেশের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেবার পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

মো. রায়হান হোসেন, ওমান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 12:16 PM
Updated : 13 July 2017, 01:18 PM

বাংলাদেশি প্রবাসীসহ এর মধ্যে রয়েছেন ওমানি, ইয়েমেনি, মিশরিয়, সুদানি, সৌদিয়ান, নেপালি, ভারতীয়, পাকিস্তানি, চাইনিজ, ফিলিপিনো, ব্রিটিশ ও ইন্দোনেশিয়ান। আর সেইসাথে হয়েছে নানা রকমের অভিজ্ঞতা, ঘুরে বেড়িয়েছি ওমানের বিভিন্ন শহরে, দেখেছি মরুভূমিতে বেদুইনদের জীবনযাত্রা।

আমার পরবর্তী লেখায় সেইসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা আর কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পেতে হয় সে সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

২০১৬ সালের অগাস্টে বাংলাদেশ বিমানের সকাল ৭টার ফ্লাইট। ছোট দুই ভাই আর বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বোর্ডিয়ের অপেক্ষায়, বারবার শুধু মায়ের ভেজা চোখটার কথা মনে পড়ছিলো। মায়ের কাছ থেকে এতো দূরে কখনো থাকা হয়নি।

বোর্ডিংয়ের আগ মূহুর্তে মাকে ফোন দিয়ে আর একবার বিদায় বলবো বলে মোবাইল হাতে নেবার সাথে সাথে মায়ের ফোন, আমি আর মা দুজনেই কান্না লুকানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হই। ভারি কণ্ঠে বিদায় বলেই পাড়ি জমাই মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশ্যে। প্লেন যতো উপরে উঠে চোখ ততো ভিজে উঠে।

ছোটবেলা থেকেই আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের সংস্পর্শে আসবো। আজ আমার স্বপ্ন পূরণের দিন। ছোটবেলায় যখন অ্যারাবিয়ান নাইটস দেখতাম তখন থেকেই আরব সংস্কৃতির ছোঁয়া পাবার অদম্য ইচ্ছে মনে ভর করে।

অ্যারাবিয়ানদের পোশাক, অ্যারাবিয়ান সঙ্গীত, উটের পিঠে চড়ে মরুর বুকে ছুটে চলা কিশোর হৃদয়কে নাড়া দিত। আর ঢাকার বাণিজ্য মেলায় নানা দেশের বর্ণিল স্টলগুলোর মধ্যে অ্যারাবিয়ান স্টলগুলো আমাকে মুগ্ধ করত।

প্রিয় বন্ধুদের সাথে আড্ডায় জমে থাকা আর তাদের সাথে নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে আমার। আজ যে পথে পাড়ি জমিয়েছি তার প্রায় পুরোটাই অজানা। বারবার মনে হচ্ছিলো বন্ধুদের যদি নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে ভ্রমণটা ষোলকলা পরিপূর্ণ হতো।

পুরো প্লেনের এপাশ ওপাশ বাংলাদেশি লোক দিয়ে ভর্তি, দেখে ভারাক্রান্ত মনে কিছুটা আনন্দের হাওয়া বইতে লাগলো। বুঝতে পারলাম ওমানে আমার মতো আরও হাজারো বাংলাদেশির বসবাস।

আমার দুই পাশে দুই মহিলা, আর তাদের মাঝখানের সিটে আমি কাবাবের হাড্ডি বনে যাওয়ায় মনটা আবারো কিছুটা ভারাক্রান্ত হলো।

ডানপাশের সারিতে জানালার পাশে একটা সিট খালি দেখতে পেয়ে সোজা ওই সিট দখল করে বসে পড়লাম। কিঞ্চিৎ অভদ্রতা তো হলোই, এই অবৈধ সিট দখল করাকে বৈধতা দেবার জন্য বিমানবালাকে বুঝিয়ে বললাম, শুনে তিনি মুচকি হেসে বললেন কোনও অসুবিধা নেই। মহিলা এমনিতেই সুন্দরী, তার উপর শাড়ি পড়েছেন, দেখে মনে হচ্ছে শাড়ি নামক পোশাকটা শুধু উনার জন্যই তৈরি হয়েছে, শাড়িতে কাউকে এতো সুন্দর লাগে আগে কখনোও এভাবে খেয়াল করা হয়নি। হাসলে উনার গালে ছোট টোলও পড়ে, এমন স্বর্গীয় হাসি মন ভাল করে দেয়।

আমি জানালা দিয়ে বাইরের মেঘমালা দেখি, স্তরে স্তরে মেঘের সারি যেন শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা। জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া মেঘের সারিতে যেন হাত বুলিয়ে দিতে মন চায়। মেঘের ভেতর দিয়ে উড়ে চলে আমার প্লেন আর পেছনে পড়ে থাকে আমার চিরচেনা সবুজ শ্যামল জন্মভূমি। দেশ না ছাড়লে কখনো বোঝা যায় না এই ভালবাসার গভীরতা।

আড়াই ঘণ্টা পর দুপুরের খাবার সার্ভ করতে দেখে আমার মনে হতে লাগলো প্রতিদিন তিনবার করে যেটা আমি সবচেয়ে বেশি মিস করবো সেটা হচ্ছে আমার প্রিয় দেশি খাবার। বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট হবার সুবাদে আরও একবার স্বদেশি খাবার দারুণভাবে উপভোগ করলাম, খাবার শেষ হয়ে যায় তবু তার স্বাদ লেগে থাকে জিভে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই, ঘুম ভাঙলো পাইলটের কণ্ঠ শুনে। জানলাম আর মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা ল্যান্ড করবো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি, নিচে সাগর দেখা যায়, আরব সাগর। উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে খুব শান্ত নীল রংয়ের সাগর, কেন জানি মনে হলো সাগরের এই নীল রংয়ের মন ভালো করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি সেই দিকে মন ভালো না হয়ে উপায় নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ড করবো। এবার মনে হয় কিছুটা আশাহত হলাম, যতদূর দেখতে পাচ্ছি সবুজ কিছু চোখে পড়ছে না, শুধু ধূধূ মরুভূমি। কেমন জানি সব শুন্য মনে হতে লাগলো। আমি দীর্ঘশ্বাস নিতে নিতে মাস্কাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের মাটি ছুঁলো বাংলাদেশ বিমানের চাকা।

স্থানীয় সময় দুপুর দেড়টা। হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে প্লেন থেকে নেমেই মনে হলে রোদের তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। ওমা সে কি ভয়ঙ্কর রোদের তাপ! যাক, বেশিক্ষণ সহ্য করতে হয়নি। কিছুক্ষণ পরেই বাস এসে সবাইকে উঠিয়ে নিলো।

ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ওয়াইফাই চালু করে বাসায় কথা বলার চেষ্টা করলাম। সম্ভব হলো না, কল রিসিভ হলেও কথা শোনা যায় না। তখন জানতাম না কেন এমন হলো! পরে জানতে পেরেছিলাম মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইমো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে ভিপিএন অ্যাক্টিভ থাকতে হয়।

এয়ারপোর্টের সবগুলো কাউন্টারেই পুরুষ মহিলা সবাই ওমানি কাউন্টারম্যান। পুরুষরা প্রায় সবাই লম্বা দেহের ফর্সা গড়নের সুঠামদেহী সুদর্শন। মাথায় পাগরির মতো পেঁচিয়ে কী একটা যেন পড়ে, কিন্তু সেটা খুব সুন্দর লাগে।

পরে জানতে পেরেছিলাম এটাকে ‘টারবান’ বলে, কেউ বলে ‘মাসার’। আর তার সাথে পড়ে লম্বা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক যাকে ওরা ‘কান্দুরা’ বলে। পোশাকটাতে সবাইকে খুব সুন্দর লাগে। এটাই তাদের জাতীয় এবং অফিসিয়াল পোশাক।

মহিলারা সবাই চোখ ধাঁধানো সুন্দরী, কালো রংয়ের বোরখা পড়েন। এটাই তাদের অফিসিয়াল ড্রেস, চেহারা ঢাকতে হয়না বলে ফর্সা চেহারা সহজেই চোখে পড়ে। লম্বা গড়ন, খাড়া নাক, টানা টানা চোখ। জানি না এই চোখের কী নাম! শুধু জানি একবার চোখ পড়লে মরণ ছাড়া গতি নেই!

মায়াময়ী সেই চেহারার দিকে তাকিয়ে যদি কেউ আনমনা হয়ে যায় তাতে দোষের কিছু আছে? কেন জানি মনে হল পৃথিবীর সব বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের জন্ম হবার কথা এখানেই।

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন হালকা ধাক্কা দিয়ে বললেন, ভাই সামনে আগাচ্ছেন না কেন আপনি? তাকিয়ে দেখি লাইনে ইতিমধ্যে গ্যাপ পড়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বের হয়ে দেখি ‘ডাক্তার রায়হান’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝলাম তিনি নেপালি ড্রাইভার রানা যার আমাকে রিসিভ করার কথা।

(চলবে)

লেখক: মেডিকেল অফিসার, রিনাইসেন্স পিএসি ক্লিনিক, ওমান

ই-মেইল: dr.mrhossain87@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!