লন্ডনের চিঠি: ক্লান্তি ছাপিয়ে প্রশান্তির পার্কে

অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিলো এই দেশের পার্কের পরিবেশ ও তার ব্যবস্থাপনার উপর  ভিত্তি করে কিছু লিখবো। কারণ নিজের দেশের পার্কের সাথে তুলনা করলে ভিন্নতা দেখতে পাই।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2017, 08:01 AM
Updated : 5 July 2017, 08:05 AM

আগে ধারণা ছিলো, আমাদের দেশ শুধু সবুজে ঘেরা। কিন্তু এই দেশে আসার পর ধারণাটি ভেঙ্গে গেলো। লন্ডনে আপনি যেদিকে তাকাবেন, শুধু দেখবেন গাছপালা আর গাছপালা। সেই সাথে রয়েছে বেশ কয়েকটি পার্ক।

লন্ডনকে অনেকেই শহুরে জাতীয় উদ্যানও বলে থাকে। এই দেশের বিনোদনের আরেকটি জায়গা যে পার্ক, তা আগে জানতাম না। তবে বেশিদিন সময় লাগেনি পার্কের মর্ম বুঝতে। কারণ দিন শেষে কর্মক্ষেত্রের ক্লান্তি ও মানসিক চাপ দূর করার জন্য যখন আমি বা আপনি পার্কে যাই, তখনই বুঝতে পারি ক্লান্তির অবসানের ক্ষেত্রে পার্কের ভূমিকা কতোটুকু।

যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি অবাক লেগেছে, তা হলো এই দেশের প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে একটি করে পার্ক রয়েছে শুধুমাত্র শিশুদের মনন বিকাশ ও এলাকাবাসীর প্রশান্তির জন্য। এক কথায়, পার্ক এমন একটি জায়গা যেখানে যাওয়া মাত্রই আপনার ও আমার মনটা ভালো হয়ে যাবে। সেই সাথে মুগ্ধ হয়ে যাবেন সেখানকার পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা দেখে।  

সকালের হাঁটা থেকে শুরু করে বিকেলের আড্ডাটা পর্যন্তও পার্ককে ঘিরেই হয়। এমনকি ছুটির দিনগুলোতে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব মিলে ছোটখাটো পিকনিকেরও আয়োজন করা যায়। বলতে গেলে, মানসিক প্রশান্তি ফিরে পাওয়ার অন্যতম জায়গা হচ্ছে পার্ক।

আমাদের দেশে এই ধরনের পার্ক সচরাচর দেখা যায় না বলে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারি না। আগে জানতাম, পার্ক শুধু বড়দের জন্য। কিন্তু এই দেশে আসার পর ধারণা পাল্টে গেলো। শুধু যে বড়রা পার্কে যায় তা নয়, শিশুরাও যাতে যেতে পারে সেজন্য শিশুদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের খেলনা। মানে রাইডসের ব্যবস্থা। এমনকি সাইকেল ও স্কুটি চালানোর জন্য আলাদা জায়গাও রয়েছে।

বড়দের জন্যও ফুটবল, বাস্কেট বল ও শারিরীক ব্যায়াম করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। এছাড়াও আছে ক্যাফে শপ। বসন্তের আগমনী বার্তাটুকুও পাওয়া যায় পার্কের গাছ-গাছালি ও নানা প্রজাতির ফুলের শোভা দেখে। আরেকটি কথা, এই দেশে কিন্তু পার্কের নির্দিষ্ট সময়সূচি রয়েছে। ইচ্ছে করলে কিন্তু আপনি যখন-তখন আসতে বা ঢুকতে পারবেন না।     

তবে পার্কেরও কিছু নিয়ম আছে যা আমাদের দেশে দেখা যায় না। ঘটনাটি উল্লেখ করলে হয়তো আরও ভালোভাবে আপনারা বুঝতে পারবেন। আমাদের বাসার সামনে একটি পার্ক আছে, যে পার্কে আমি প্রায়ই সময় ঘুরতে বা বেড়াতে যাই সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য।

একদিন আমি আমাদের এই পার্কের গাছের ফুল স্পর্শ করতে গিয়ে হঠাৎ করে দূর থেকে একজন লোক এসে আমাকে বললো, “ম্যাডাম, দয়া করে ফুলগুলো ধরবেন না। এইখানে নোটিশ দেওয়া আছে, ফুল স্পর্শ বা ছেঁড়া নিষেধ।”

আসলে সত্য কথা কি, ওই সময়ে আমার পরিকল্পনা ছিলো ফুলটি ছেঁড়ার। কিন্তু লোকটির কথা শুনে সাথে সাথে মাটি চাপা দিলাম ফুল ছেঁড়ার স্বপ্নটি। আবার সেই সাথে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো, ফুল হলো পার্কের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য, ছেঁড়ার জন্য নয়। এমনকি বড় বড় গাছগুলোর গায়ে আঁকা বা লেখাও যাবে না বা ডালও ভাঙ্গা যাবে না।

সেদিন আরেকটি জিনিস দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম। আমি পার্কে যে বেঞ্চে বসেছিলাম, পাশেরটিতে একজন মহিলা বসেছিলো। তার হাতে তার পোষা কুকুরও ছিলো। হঠাৎ দেখলাম মহিলা ব্যাগ থেকে পলেথিন ব্যাগ বের করে কুকুরের বিষ্ঠা উঠিয়ে বিন করলো। কারণ যেখানে-সেখানে পোষা কুকুর বা বিড়ালের বিষ্ঠা ফেলা যাবে না, এমন ধরনেরও নিয়ম রয়েছে।

শুধু তাই নয়, আপনি যদি কোনো খাবার নিয়ে যান, তাহলে যাতে ঠিকমতো বিন করতে পারেন, সেজন্য পার্কের কোণায় কোণায় বিন বক্সও রয়েছে। যেখানে সেখানে খাবারের ময়লাও ফেলা যাবে না।

একদিক দিয়ে ভালোই। এই ধরনের নিয়মের জন্য হয়তো প্রত্যেকটি পার্ক এতো পরিষ্কার-পরিছন্ন মনে হয়। মাঝে মধ্যে খুব অবাক হয়ে যাই যখন দেখি, প্রত্যেকটি নিয়ম এই দেশের মানুষগুলো ঠিকমতো পালন করছে।

আমরা শুধু কথায় কথায় সরকারকে দোষারোপ করি, কিন্তু নিজেদের যে পরিবর্তন দরকার ওইদিকে খেয়াল রাখি না। আমাদের দেশেও যে পার্কগুলো রয়েছে, আমরা কয়জন মানুষ সেগুলো দেখভাল করি বা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি?

আসলে নিজেদের পরিবর্তন যদি নিজেরাই করতে পারি, তখন আর নিয়মের দরকার হয় না।    

লেখক:

 প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী     

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!