প্রবাস জীবনে ঈদ একটা শব্দ মাত্র

জীবনে প্রথম মা-বাবা, বোনদের ছেড়ে ঈদ করছি। যদি অনুভূতির কথা বলি, তাহলে বলতে হবে ভালোই কাটছে। যদিও এটা একটা খুবই ‘কমন ডায়ালগ’ হয়ে গেছে।

হাবিবা  আক্তার, জার্মানির লাইপজিক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2017, 06:35 AM
Updated : 27 June 2017, 06:35 AM

ঈদ মানে আনন্দ, সেটা জীবনের প্রতিটা ঈদেই ছিল। আমাদের পরিবারে ঈদ উদযাপন ছিল খুবই স্বাভাবিক। প্রতিটি ঈদে ঘুম ভাঙতো আম্মুর ডাকে। বলতো, “তোমরা কী ঘুম থেকে উঠবে না মেম সাহেবেরা?”

সবার ছোট বোনকে বলতাম, “তুমি ছোটো, তুমি আগে ওঠো।” দুই পাশের বড় বোনদের চাপাচাপিতে বেচারা ছোট বোন আগে উঠে যেতো, আম্মুকে সাহায্য করতো। পরে আব্বু এসে বলতো, “আজ ঈদের দিন একটু আগে ওঠো।” দুই পাশ থেকে আওয়াজ যেতো, “এইতো উঠছি।”

মিনিট বিশেক পর আবার আব্বু এসে বলতো, আমি কি নামাজ পড়তে যাব

না?” মেজো বোন উঠে যেতো।  সে দেখতাম আব্বুকে গোসলের জন্য পীড়াপীড়ি করতো, আব্বুকে সুবোধ বালকের মতো গোসল করিয়ে দিতো। যখনই দেখতাম মেজো বোন এটা করছে, আর ছোট বোন আম্মুকে সাহায্য করছে, তখনই ধরফর করে উঠে যেতাম আব্বুর নামাজের পাঞ্জাবি-প্যান্ট ইস্ত্রি করে দিয়ে আব্বুকে প্রস্তুত করতে।

নামাজের আগে আব্বুর মিষ্টি কিছু খাওয়া চাই। সেটা এনে দিতাম, কারণ আমিও আমার অন্য বোনদের থেকে পিছিয়ে থাকতে চাইতাম না।  বড় বলে জোরও  বেশি ছিল। আব্বু খেতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমরা। যেনো তিন মায়ের এক সন্তান, আব্বুকে তখন এতো সুন্দর লাগতো বলার মতো না।

আব্বু নামাজে চলে যেতো। দুই বোনকে বলতাম, “যাও আগে তোমরা গোসল করো, পরে আমি করবো।” ঘুরেফিরে ছোটোর পালা আগে আসতো, সে রাগে কষ্টে আগে গিয়ে গোসল করে আসত। বলতাম, “আমি ঘর গুছাচ্ছি, আগে তোমরা করো।” মেজো বোনের পালা আসলে বলতো, “আমি আম্মুকে সাহায্য করছি, তুমি আগে করো।”

অজুহাত খুঁজতো সবাই। ধমক দিয়ে বলতাম, “আমি আম্মুকে সাহায্য করছি, তুমি আগে যাও।” ফুলেফেঁপে সেও যেতো। যখন বের হতো, সাথে সাথে বলতো- “এবার তুমি যাও।” ‘যাচ্ছি’ বলেও তখন কাজ হতো না। বলতো, “এখনই যাও এবং আজকের জন্য তাড়াতাড়ি বের হও দয়া করে।” যদিও সে নিজেও অনেক সময় লাগাতো গোসলে। 

আমি গোসলে যাওয়া মানে রীতিমতো ভয়ানক ব্যাপার! যখন দেখতো ৩০ মিনিটের মতো হওয়ার পরও বের হচ্ছি না, তখন একে একে ছোটো থেকে আম্মু পর্যন্ত বলতো- “আজকে কি বের হওয়ার ইচ্ছে আছে মা। আরেকটু থাকো ভেতরে।” শেষে হয়তো কয়েকবার তাদের সিগন্যালে বের হতাম।

এর মধ্যে আম্মুর সব রান্না হয়ে যেত। আম্মুকে বলতাম, “তুমি তাড়াতাড়ি গোসল করে আসো। আমি বাকি রান্নাটা শেষ করি।” আব্বু আসার সাথে সাথেই আম্মু এবং আব্বু- দুই জনকে একসাথে বসিয়ে সালাম করতাম। উদ্দেশ্য ছিল সালামী। আমি যেহেতু বড়, তাই আমিই আগে করবো এবং করতাম।

ছোট বোনের সালামী পর্ব আসলে আগেই আব্বুকে বলতো, “কতো টাকা দিবেন আগে বলেন, পরে সালাম করবো।” আব্বা রীতিমতো বলতো, “আমি টাকাও দিব না, আমার সালামও লাগবে না।” সব সময় মজা করতো আব্বু ওর সাথে।

শেষে জোর করে সালাম করতো, আর আব্বু তাকে টাকা দিতে শুরু করতো ২ টাকা থেকে। ও বলতো, আপনার টাকার আপনার কাছেই রাখেন আমার লাগবে না।  এর পর পর্যায়ক্রমে ৫, ১০, ২০... এভাবে চলতো। আর আব্বু বলতো, “হয়েছে?” আমরা হাসতাম পাশ থেকে। যতক্ষণ না সে বলতো ‘হয়েছে আব্বু’, আব্বু দিতেই থাকতো। আম্মুও আমাদের দিতো।

আম্মুকে জোর করে নতুন জামা পরাতাম।  পরে  তিনি বলতেন, “এবার তুমি পরো।” আমি ঈদের দিন শেষ নতুন  জামা পরেছিলাম ২০০৩ সালে, যদিও আব্বু- আম্মু অনেক রাগ করেও পরাতে পারতো না।

সামালীর পর্বটা সবশেষে আসত আমার ওপর। সেটা বুঝলেই বলতাম,  “আমি যাই, একটু কাজ আছে।” কিন্তু নিস্তার ছিল না। শেষে দিতাম আর কি! ওদের জন্য আগেই অফিস থেকে বলে  নতুন টাকা এনে রাখতাম, কিন্তু জানাতাম না।

খাওয়া হতো সবাই মিলে একসাথে।  তারপর বোনদের বায়না ছিলো, “চলো, ঘুরতে যাব।”  বলতাম,  “মাথা ব্যথা, কেমন কেমন যেনো লাগছে। না গেলে কি হয়।” এর আগেই ছোট বোনকে আমরা দুইজনের একজন সাজিয়ে দিতাম। সে কিছুক্ষণ বাড়ির আশেপাশে তার বয়সীদের সাথে টহল দিয়ে নতুন জামা-জুতা দেখিয়ে আসত। আর বলতো, তারটাই সবার থেকে সেরা।

দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত চলতো বোনদের বেড়াতে যাওয়ার বায়না। শেষ পর্যন্ত আমি এমন কিছু বলতাম মেজোকে যে তার ফোলা গোল গোল গাল দু’টিতে এক কেজি করে চাল ভিজিয়ে বল বানিয়ে ফেলতো। আর বলতো, “জীবনেও ঘুরতে যাব না। আর বলবো না তোমাকে।”

ছোট বোন এসে বলতো, “তুমি কেন নাসরিন আপুর মন খারাপ করে দিয়েছো? আমরা কি কোথাও ঘুরতে যাই তিন বোন ছাড়া?” বলতাম,  “ঈদ মানে কিছুই না, একটা শব্দ মাত্র।” এটা কখনোই মন থেকে বলতাম না তাদের। শুধু দেখতাম তারা কেমন করে।

একটু পর নিজে গিয়েই মেজোকে বলতাম, “চলো, যাব ঘুরতে।” সে তো কোনোভাবেই মানবে না।  ঘণ্টাখানেকের মতো চলতো আমাদের বোনদের এই নাটক। শেষে বলতাম,  “আমার সাথে যাবে কেন? সে তো যাবে তার বন্ধুদের সাথে।” শেষে হেসে দিয়ে ঠিকই রেডি হয়ে আমরা বের হতাম, ছবি তুলতাম।

আম্মু এর-ওর বাসায় একটু দেখা করে এসে আমাদের সাথে গল্পে যোগ দিতেন। নানাবাড়ির কথা বলতেন। কবে যাবেন, সেটা বলতেন। পৃথিবীতে যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, সবচেয়ে সহজ-সরল কী? এক কথায় আমাদের তিন বোনের উত্তর হবে, ‘আমার মা’।

প্রতিটি ঈদ ছিলো এমনই। শুধু আজ প্রথম মনে হচ্ছে,  অনেক দূরে চলে এসেছি। আমার ‘হোম বেগার’ ( ঐশী ) এবং ‘লক্ষী’ ( মিথিলাকে) কে আজ বলতে চাই, আজ জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে, ঈদ সত্যিই একটা শব্দ। সেদিন তোমাদের সাথে মজার ছলে বললেও আজ এটা সত্যিই নিছক একটা শব্দ হয়ে গেছে।

আমি জানি, আজ আমি যেমন অনুভব করছি, তোমরাও সেইরকম করছো। আমি জানি, আমার সবচেয়ে সহজ-সরল মানুষটিকে জোর করে খাওয়াতেও কষ্ট হচ্ছে। সে কাউকে তার কষ্টের কথা বলতে পারে না। আমাদের তিন মায়ের এক সন্তান  তাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে নিজে আড়ালে গিয়ে কাঁদছেন একা একা। আমার বোনেরা যে যার রুমে ব্যস্ত থাকার কথা বলে মেক আপ ছাড়াই চোখ দুটো লাল বড় বড় করে ফেলছে।

আমার জান্নাত আমার পরিবার। বেঁচে থাকতে এবং মরার পরেও আমি এই জান্নাতে থাকতে চাই।

সবাইকে একটা শব্দের শুভেচ্ছা। বিশেষ করে আমার মতো যারা প্রবাসে আছেন, সবারই হয়তো আমার মতো পারিবারিক আনন্দগুলো এভাবেই শব্দ হয়ে গেছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইন্টারন্যাশনাল ফিজিক্স স্টাডিজ প্রোগ্রাম, মাস্টার্স প্রোগ্রাম,  লাইপজিক ইউনিভার্সিটি।

ইমেইল: akterhabiba5@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!