প্রবাস জীবনে ঈদ মানে কষ্ট

ঈদ মানেই সুখ, ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই অনাবিল ভালবাসা। কিন্তু প্রবাসীদের জন্য ঈদ মানে বেদনা, ঈদ মানে যন্ত্রণা, ঈদ মানে প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আকুতি। ঈদ মানে মনে শত কষ্ট নিয়েও বলা,  “হ্যা, আমি ভাল আছি।”

মাহাফুজুল হক চৌধুরী, সাইপ্রাস থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2017, 05:47 AM
Updated : 17 June 2017, 05:47 AM

সাইপ্রাস আসলাম আড়াই বছর হল মাত্র। এই অল্প দিনেই বুঝে গেলাম- প্রবাস মানে কী? আসার ছয় মাস পর জীবনের প্রথম প্রবাসে ঈদ করলাম। সেইবার কর্মব্যস্ত জীবনে হুট করে ৩০টা রোজা কোনদিকে শেষ হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। ঈদের আগের দিন রাতে জানতে পারলাম, আগামীকাল ঈদ।

সাইপ্রাস মুসলিম অধ্যুষিত দেশ না হওয়ায় এবং আরও কিছু কারণবশত এইখানে মুসলমানদের ধর্মীয়ভাবে কোনো সরকারি বন্ধ নেই। নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহে রোববার বন্ধ এখানে। সেদিন হয়তো শুক্রবার ছিল ঈদের দিন। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ ছিল আমার এবং শুক্রবারও বেশ কাজের চাপ। ওইদিন আমাদের ঈদ হলেও তো আর এদের কিছু না। তাই ঈদের কোন আমেজ তো দূরের কথা, কাল যে ঈদ, সেটাও জানতাম না।

যাই হোক, রাতে যখন জানতে পারলাম আগামীকাল ঈদ হবে, তখন কয়েকজনকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস

করলাম- ঈদের নামাজ কয়টায়? ঈদের নামাজ ছিল ৭টায়। কোনোরকমে পুরাতন শার্ট আর প্যান্ট পরে ঈদের নামাজ পড়তে গেলাম। নামাজ পড়তে না পড়তে কোনদিকে ৮টা বেজে গেল, কে জানে?

কাজ থেকে ফোনের পর ফোন আসছে, যেন তাড়াতাড়ি কাজে যাই। কারণ আজকে কাজের চাপ খুব বেশি। এইদিকে পুরো শরীর ব্যাথা করছে। মন চাইছে, একটু ঘুমাই। কী আর করা, চলে গেলাম কাজে।

তখন কাজের মধ্যে বাড়ি থেকে সবাই ফোন দিচ্ছে, ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে- কী রে, আজকে তো ঈদ। তোর ঈদের আনন্দের প্রস্তুতি কেমন? জামা-কাপড় কতো টাকা দিয়ে কিনলি? ঈদের জন্য কী রান্না করলি? আরও কতকিছু!

হায় রে, বিদেশ জীবন তাদেরকে কীভাবে বুঝাই। এটা যে বিদেশ, এখানে এসব নাই। চোখের পানি কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিল না। একদিকে কাজ করি, অন্যদিকে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। দেশের সেই ঈদের

আনন্দের দিনগুলি বারবার মনে পড়ছে। তখন ঈদের জন্য কতো কিছু বাজেট করতাম। এত টাকা দিয়ে শপিং করব,ওখানে-সেখানে যাব, ওইখানে এটা খাব! এইরকম আরও কতো শত পরিকল্পনা করতাম, তার কোন শেষ নাই।

যখন ঈদের দিন নামাজ পড়ে বেড়াতে বের হতাম, তখন কতো আপ্যায়ন সবার ঘরে ঘরে। এ বলে এটা

 খাও,ও বলে সেটা খাও! না, আজকে তোমাকে এটা খেতেই হবে। কতো যায়গায় এই রকম জোর করে করে

খাইয়েছে, কিন্তু আজ প্রবাস জীবনে এটুকুও কেউ বলে না- “সেমাই খাও।”

যাই হোক,সেইবার কোন রকম দুঃখ-বেদনায় কাটিয়ে দিলাম ঈদের আমেজ। চিন্তা করলাম, আগামী বছরের ঈদ বেশ জাঁকজমকভাবে পালন করব। কিন্তু যখন পরের বার আবার ঈদ আসলো,  ঈদ করার

আগ্রহ অনেক কমে গেল। আস্তে আস্তে যখন বুঝতে পারলাম,  এইখানে শুধু আমি না, সবারই একই অবস্থা, তখন নিজের কষ্টটা অনেক হালকা হয়ে গেল। সবাই যেখানে দুঃখী,  সেখানে আমিও তাদের দুঃখে দুঃখী হয়ে সুখী হই। এইভাবে কেটে গেল দ্বিতীয় ঈদ।

এইবার আবার হুট করে বছর না ঘুরতেই কোনদিকে ঈদ চলে আসল। আহারে ঈদ, কোথায় গেল ঈদের শপিং? কোথায় গেল ঈদের সেমাই? ঈদের আমেজ তো দূরের কথা, এখন কেউ ঈদের কথা বললেই মনে হয় যেন টিটকারি মারতেছে।

জানি না, এভাবে প্রিয়জন হারা জীবন থেকে আরও কত ঈদ চলে যাবে? তবে ভাল থাকুক আমার মত প্রিয়জনবিহীন সারা বিশ্বের সকল প্রবাসীরা, ভাল কাটুক দেশের সকল প্রিয়জনদের ঈদ। এই প্রত্যাশাই রইল সবার প্রতি।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি