দেশে থাকতে ইফতার করার সময় অপেক্ষা করতাম আজানের জন্য। আজানের ধ্বনি শোনা মাত্রই খাওয়া শুরু করতাম। আবার সেহরি করার সময়ে বাংলাদেশে দেখতাম, পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেহরি খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করে।
সিঙ্গাপুরে এই বিষয়গুলোর অনুপস্থিতি টের পাচ্ছি। আমাদের আগের বাসাটা ছিল মসজিদের খুব কাছেই। কিন্তু আজানের শব্দ কানে আসেনি কখনও। ভোরবেলা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেউ সেহরি খাওয়ার জন্য ডেকে দেবে, সেটা কল্পনাও করা যায় না এখানে।
এখানে ঘড়ি আর ঘড়ির অ্যালার্মই একমাত্র ভরসা। রোজার শুরুতেই সেহরি ও ইফতারের সময়সূচি প্রকাশ করা হয়েছে, তা দেখেই ইফতার করতে হয় এবং সেহরি খেতে হয়।
এমন নয় যে এখানে মুসলমান নেই বলে এভাবেই রোজা পালন করতে হচ্ছে। সিঙ্গাপুরেও প্রচুর মুসলমান বাস করে। প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে মুসলমান। তেমনি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ রয়েছে এখানে।
তবে হ্যা, কিছু বিশেষায়িত এলাকা আছে যেসব জায়গায় গেলে আপনি আজানও শুনতে পাবেন, আবার পূজার ঘণ্টাও শুনতে পাবেন। যেমন, আরব স্ট্রিটে গেলে সুলতান মসজিদের সুরেলা আজান কানে আসে। এখানে একটা আবহই রয়েছে তেমন।
চারপাশের দোকানগুলোতে রঙ-বেরঙের গজ কাপড়, বোরকা দেখা যায়, সুগন্ধি অ্যারাবিক চা ও হাতে বোনা পার্সিয়ান কার্পেট চোখে পড়ে। আবার লিটল ইন্ডিয়ায় গেলে মন্দিরের ঘণ্টা শুনতে পাওয়া যায়। সেখানকার বাজারে পূজার সরঞ্জামাদি চোখে পড়ে।
তবে যে যেই পরিবেশে বড় হয়েছে, সে তার পুরনো পরিবেশটার অনুপস্থিতি অনুভব করবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমার বেলায়ও তাই ঘটেছে। বছরের এই সময়টায় দেশের কথা মনে পড়ে খুব বেশি।
রমজান মাসে পুরো বাংলাদেশের চেহারা বদলে যায়। পাড়ায় পাড়ায় দোকানিরা হরেক রকমের ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে। বিকেল হলেই প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে চলে ইফতার তৈরির প্রস্তুতি। প্রতিবেশীরা একে অন্যের বাড়িতে ইফতার সাজিয়ে নিয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব মিলে ইফতার পার্টি আয়োজন তো রয়েছেই। এসব খুব মিস করছি।
ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি হলো বাঙালি খাবার। এদেশের মুসলমানরা ইফতার করে তাদের পছন্দের খাবার দিয়ে, যার বেশিরভাগই আমি চিনি না। রোজা শুরু হওয়ার পর থেকে পত্র-পত্রিকায় দেখছি, কোথায় কোথায় হালাল ইফতার পাওয়া যাবে, সেসব বিজ্ঞাপন।
খুব হা-হুতাশের কারণ নেই অবশ্য। ঠিক যে জায়গায় বাস করছি, সেখানে রমজান মাসের দেশি আমেজ না পেলেও, একটু দূরে গেলেই সব পাওয়া যায়। যেমন- সেরাঙ্গুন এলাকায় গেলে মুস্তাফা সেন্টারের আশেপাশের বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোতে প্রায় সব ধরনের বাংলাদেশি ইফতার পাওয়া যায়। ওই জায়গাটাকে আমার কাছে সিঙ্গাপুরের বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ মনে হয়।
রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই শুনতে পাই কোনো দেশি ভাইয়ের গলার আওয়াজ। দোকানে দোকানে বাংলাদেশি শাক-সবজি আর মাছ। আমরা প্রায় প্রতি মাসেই একবার করে সেরাঙ্গুন এলাকায় গিয়ে বাজার-সদাই করে আনি। ইচ্ছে আছে রমজান মাসেও যাব সেখানে ইফতার করতে।
আজ আর কথা বাড়ালাম না। রমজান মাস মুসলমানদের ঘরে ঘরে সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক, সেই প্রত্যাশায় বিদায় নিচ্ছি। ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
লেখক: রোকেয়া লিটা, লেখক ও সাংবাদিক
ই-মেইল: rokeya.lita@hotmail.com
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |