প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা

টাঙ্গাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছিলো ‘বাতেন বাহিনী’। সেই বাহিনীর প্রধান খন্দকার আবদুল বাতেন এখন সংসদ সদস্য।

জাহাঙ্গীর কবীর বাপপি, আবু ধাবি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2017, 09:54 AM
Updated : 19 May 2017, 10:09 AM

সম্প্রতি আবু ধাবিতে তার মেয়ের কোলজুড়ে এসেছে এক ফুটফুটে শিশু। তাকে দেখতেই এসেছিলেন এই কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা। দেরিতে খবর পাওয়ায় তার দেশে ফেরার ঠিক আগ মুহূর্তে দেখা করতে গেলাম। মূলত মুক্তিযুদ্ধের এরকম একজন সংগঠককে বিদেশ বিভূঁইয়ে কাছে পাওয়ার যতোটুকু সহজ সুযোগ হয়, দেশে গেলে হয়তো ততোটা সুযোগ পাওয়া নাও যেতে পারে- সেটা ভেবেই ছুটে যাওয়া!

আবু ধাবির আল ওয়াদাহ মলের পাশেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বাড়ি। সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো সেখানেই। সাথে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্দ্রিয় কমিটি আবু ধাবির সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল, ইমরাদ হোসেন ইমু, শওকত আকবর, এস এম আলাউদ্দীন ও আবু তাহের তারেক। আমাদের এগিয়ে নিতে এলেন এবং বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলেন বাতেন সাহেবের মেয়ে জামাতা ।

নিতান্ত অনানুষ্ঠানিকভাবে খন্দকার আবদুল বাতেনকে ফুল দিয়ে আবু ধাবি তথা আমিরাত প্রবাসীদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানালাম। তারপরই ঢুকে গেলাম মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কাহিনিতে। কিছুটা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু প্রবাসে দেশের একজন বীরযোদ্ধার কাছ থেকে সেই ইতিহাস শোনার অনুভূতি আসলে কেমন- তা লিখে বোঝানো যাবে না।  

একাত্তরে অগ্নিগর্ভা দিনগুলোতে পাঁচ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন দুর্ধর্ষ বাতেন বাহিনী জানালেন তিনি। ছোটখাট গড়নের নিরহংকার খন্দকার আবদুল বাতেনের সঙ্গে সাক্ষাতটা পরিণত হলো প্রাণবন্ত আড্ডায়। আমাদের নানা প্রশ্নের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার স্মৃতিচারণ করলেন আবদুল বাতেন। যা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।

মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া

ভিপি হওয়ার পর টাঙ্গাইলের সাদত করটিয়া কলেজ ডাকসুর পরপরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। তখন আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলাম।  আনডিভাইডেড ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের এক নম্বর সহ সভাপতি ছিলাম আমি। সেন্ট্রালি ছিলাম ৩ নং ভাইস প্রেসিডেন্ট। স্বভাবতই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে আমাদেরকে রোল প্লে করতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নীতিগত দিক থেকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কেউ কেউ জানতে চাইতে পারেন কেবল এই দুইটা সংগঠনের নাম বললাম, অন্যদের নাম বললাম না কেন! এটা এই কারণে যে স্বাধীনতার পর এই দুটো সংগঠন এগিয়েছে বেশি। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তাঁর উৎসাহ, উদ্দীপনা, উচ্ছ্বাস এবং সেই ঐতিহাসিক বজ্রকন্ঠ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করত।

তরুণদের অগ্রদূত হিসেবে, রোল মডেল হিসেবে আমরা যদি কাউকে চিন্তা করতাম তাহলে বঙ্গবন্ধুর নামটাই আসতো। সে নিরিখেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের জানার সুযোগটা এসেছে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের বঞ্চনা উপেক্ষা, অপমান এসব কাহিনী জানতাম। এসব থেকে আস্তে আস্তে আমাদের মনে স্বাধীনতা সম্পর্কে একটা নতুন উদ্দীপনা ও স্বপ্ন কাজ করতে থাকে।

যদি বিশেষায়িত  করতে বলেন, তাহলে বলবো সাদত কলেজ, টাঙ্গাইল জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলাম আমি। তাই আন্দোলনটা আমাদের হাতের মুঠোয় ছিলো। এজন্য আন্দোলনরত আর সবার মতোই মামলা-মোকাদ্দমা, জেলখানা লেগেই ছিল। ৬৭ সাল থেকে জেলের ভাত খাওয়া শুরু করেছি। ৯ বার গ্রেপ্তার হয়েছি, ৩৯টি মামলা বহন করতে হয়েছে। এটা অসাধারণ কিছু না, রাজনৈতিক সংগ্রামে জেলজুলুম, মিথ্যা মামলা এগুলো লেগেই থাকে।

সেসময় ছাত্র আন্দোলনটা ছিল আদর্শের রাজনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুপরিসর অঙ্গনে আমাদের সোচ্চার ভূমিকা ছিল। মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছাড়া ওই আন্দোলনে কেউ নেতৃত্ব দিতে পারত না।

কাজেই তখন কোয়ালিটির প্রশ্নটা ছিল বেশি। এখন যেই মুহূর্তে আমাদের ছাত্র রাজনীতিতে কোয়ালিটির প্রয়োজনটা বেশি সে মুহূর্তে কোয়ালিটির খুব অভাব দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়।

বাতেন বাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপট

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তখন একটা আলাদা ধরনের অনুভূতির সঞ্চার হয়েছিল যে- আর কথা নয়। আমাদের বাঙালি মন-মানসিকতা, জাতিত্ববোধ, জাতীয়তাবাদ এটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে আমরা একটি আলাদা জাতি।

‘টুনেশনস’ থিওরি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে আসে। আমি সহযোদ্ধাদের বললাম, এখন তো আমাদেরকে প্রত্যক্ষ প্রস্তুতি নিতে হবে। সাবজেক্টিভ চিন্তা ভাবনা নিয়ে তো এই কাজটা করা যাবে না, অবজেক্টিভ কন্ডিশন বলে দিচ্ছে, ‘দিস'জ দ্য টাইম ফর জাম্পিং ইন দ্য ফিল্ড’।

যেভাবে অ্যাকশনে জড়ালেন

তখন হাবিলদার মাইনুদ্দীন নামে একজন ছুটিতে এসেছিলেন। তাকে সংবাদ দিয়ে আনালাম। তাকে দিয়ে ট্রেনিং শুরু হলো। তখন আমার বয়স মাত্র ২৩-২৪ বছর। সাদত করটিয়া কলেজের ভিপি আমি। ডাকসুর ভিপি-জিএস, কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের ভিপি-জিএস এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে।

এসময় শ্রমিক আন্দোলনের সাথেও জড়িয়ে পড়ি। কাকতালীয়ভাবে আমাদের আন্দোলন থেকে তাদের আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ি। যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার বৈঠক ব্যর্থ হলো, তখন আমাদের আর পিছে তাকানোর সময় নেই। কিন্তু আমাদের কাছে তো অস্ত্র নেই। আমরা বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে থেকে চেয়ে চেয়ে তাদের ব্যক্তিগত বন্দুক সংগ্রহ করছি।

এদের মধ্যে যারা মুসলিম লীগের সমর্থক তারা তাও দিতে চাইতেন না। যা হোক আমাদের হাতে তখন অস্ত্র বলতে ক'টা বন্দুকই। এই সময়ে ক্র্যাকডাউন হল। আমি তখন গ্রামের বাড়িতে মিটিং করতে গেছি। জায়গাটার নাম লাউহাটি। বিশাল মাঠ জুড়ে জনারণ্য।

তখন তো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জয় জয়কার। বক্তৃতা দেয়ার পর বাড়িতে গেলাম। যেতে বাধ্য হয়েছি। সেই রাতে কী হয়েছে তখনও জানি না। সকালে উঠে রেডিও অন করতেই উর্দু জবানে কথা ভেসে আসে। তখনই তো বুঝতে পারলাম প্রচার মাধ্যমে যখন ওরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি চড়াও হয়েছে। সাইকেলে করে পাকুল্লা এলাম, সেখান থেকে টাঙ্গাইল শহরে।

তখন ওয়ারলেস বার্তা এলো এম রহমান (মুজিবুর রহমান) এর নামে। সাথে সাথে ইংরেজি বার্তাটা অনুবাদ করে বিভিন্ন থানায় তা পৌঁছে দিলাম। এরপর পাক বাহিনী করটিয়া আক্রমন করলো। এটা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। বাজারটা পুড়িয়ে দেয়া হল, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলাম। আমরা করটিয়ার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সংগঠিত হলাম। চতুর্দিক থেকে দাবি উঠছিলো কোথাও থেকে অস্ত্র বের করেন। লাউহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল খান। তার কাছে যেয়ে বললাম, “খান সাব অস্ত্র নাই। দেহটা ছাড়া আমাদের আর দেবার কিছু নাই, কী করব? অস্ত্র পাওয়া গেলে চেষ্টা করতাম।”

কামাল খান একটা ডোবা থেকে ৪টা রাইফেল বের করে দিলেন। এইতো, এইখান থেকে যাত্রা শুরু বাতেন বাহিনীর।

কাদেরিয়া বাহিনী তখনও গঠন হয়নি

কাদেরিয়া বাহিনীর গঠন হয়নি, তবে একটা বাহিনী গঠিত হয়েছিল। টাঙ্গাইল অস্ত্রাগার থেকে তারা কিছু অস্ত্র পেয়েছিল। আসাদুজ্জামান সাহেব তখন সচিব। তিনি অস্ত্র বের করে দিয়েছিলেন। আমি তখন সেখানে ছিলাম না। টাঙ্গাইলের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, যুদ্ধ, স্বাধীনতা- এগুলো তো কাদের সিদ্দিকীর কাছে ছিল না। তিনি ছিলেন আর্মিতে একজন সমরযান চালক। জানি না কী কারণে আর্মি থেকে চলে এসেছিলেন। পেনশনটা পান না কেন- এ রহস্য তিনিই জানেন।

পেনশন না পাওয়া মানে তার চাকরি ছিলো না। যে বইটি তিনি লিখেছেন, যদিও নিজের হাতে না, অন্যের হাতে- অনুলিখন। তার সেই বই ‘স্বাধীনতা ৭১’ তারই উচিৎ ছিল এসব লেখা। পেশা লুকিয়ে লাভ নাই। আপনারাই বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ না হলে কী কাদের সিদ্দিকীর কোন পাত্তা থাকতো?

কিন্তু বাতেনের পাত্তা থাকতো। বাতেনকে থ্রু-আউট স্বাধীনতা বলেন, গণতন্ত্র বলেন, রাজনীতি বলেন, ছাত্র আন্দোলন বলেন, সবকিছুর সাথে জড়িত থাকতে হয়েছে। তৎকালীন সময়ের টাঙ্গাইলের রাজনীতিকে যদি বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখবেন টোটাল রাজনীতি আমাকে ঘিরে হয়েছিল। নিজের মুখে যা বলা মুশকিল।

কাদের সিদ্দিকী সাহেব আর্মি থেকে এসে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর আর যুদ্ধের জন্য পরীক্ষা দিতে পারেননি। এটুকুই তার পরিচয়। আর একটা পরিচয় হলো তিনি লতিফ সিদ্দিকীর ভাই। অনেকগুলো ভাইয়ের মধ্যে তিনি আপন ভাই। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার সুনামটা আমাদেরকে করতেই হবে।

রাজনীতির লাইনে তিনি ছিলেনও না, এটা বোঝেনও না। এখনও তার নিঃশ্বাসে বেরিয়ে আসে একাত্তর। কেবল ওই ‘আত্মগরিমা’ নিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকা মুশকিল।

কেমন ছিলো বাতেন বাহিনীর জনবল

তিন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা এবং দুই হাজার সহযোগী। ২৯টি কোম্পানি । প্রতিটি কোম্পানিতে ১৯০ জন করে সদস্য। আমার অপারেশন এরিয়া ছিল  সাটুরিয়া, দৌলতপুর, ঘিওর, সিংগাইর, শিবালং, আরিচা, হরিরামপুর, ধামরাই ও কালিয়াকৈর। শুধু মানিকগঞ্জ সদর থানা আমি আক্রমণ করিনি। আর সবগুলো থানা আমরা দখল করেছিলাম।

থানা দখলের পর ওখান থেকে লুট করে নেওয়া অস্ত্র থেকে আমাদের অস্ত্রের সাপ্লাই বাড়তো। এছাড়া তো আর বিকল্প রাস্তা ছিল না!

সবচেয়ে স্মরণীয় অপারেশন

সবগুলো অপারেশনই স্মরণীয় হয়ে আছে। তবে এ মুহূর্তে মনে পড়ছে একটির কথা। অক্টোবর  মাস। অস্ত্রের খুব অভাব। জনবল বেড়ে চলছে, অস্ত্র নেই। পাগলের মত খালি বুলেট আর অস্ত্র খুঁজতাম। আর সুযোগ বুঝে জায়গায় জায়গায় আক্রমন করতাম। একটা খবর এলো চৌহালি থানা, পাবনার ওইপাশে সিরাজগঞ্জের কাছে দুইভাগ হয়ে গিয়েছিলো চৌহালি। এই পাশটাকে বলা হতো জামাতের ক্যাম্প-ওটা আসলে চৌহালি নামকরণে আসতো না। ও পারে তো থানা। খবর পেলাম ওই পারে কালো কাপড় পরা মিলিশিয়ারাই আছে।

বললাম নৌকা সাজাও। বড় ছিপ নৌকা, আরোহী ৩১ জন মুক্তিসেনা। তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদী। তার ওপর ঝাপটা বাতাস। ডুবু ডুবু নৌকা নিয়ে অন্ধকার ঝড়ের রাতে আমরা পৌঁছে যাই থানা ঘাটে। গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি পজিশন নিই। আমরা চারজন, অন্যজন নৌকায় পানি সেচছে। বাকিদের আশপাশে অস্ত্রের খোঁজে পাঠালাম। থানায় দলের একজন রেকি করে আসলো। সোর্সের দেয়া সংবাদ ঠিক।

কেবল চারজন মিলিশিয়া থানা পাহারা দিচ্ছে, বাকি ফৌজরা টহলে গেছে। রাত তখন প্রায় ১২টা। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সে আলোয় আমরা পথঘাট দেখছি। সাক্ষাৎ বাঘের মুখে আমরা। কোম্পানি কমান্ডার আজগর বললো, “স্যার, সেন্ট্রি নাই, আমরা থানায় ঢুকে পড়ি?”

আমি বললাম, “না। আরও সতর্কভাবে এগোতে হবে। আমরা চারজন, ওরাও চারজন”। নৌকা থেকে আরও একজনকে ডেকে পাঠালাম। এবার অপারেশন। যেটুকু ভেবেছি তার চেয়ে সহজে আমরা ওদের নিরস্ত্র করলাম। মুখোমুখি যমকে দেখে পাকিরা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। আমরা তাদের কষে রশি দিয়ে বেঁধে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে সরে এলাম। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে আমাদের কলিজাটা এতো বড় হয়ে গেল যে ভাবলাম এই খুচরাগুলোকে মেরে আর কী লাভ! এখানে আমরা জি-থ্রি হেভি গান ১১টা, চাইনিজ গান আর দেড় লাখ গুলি পাই।

এখন বাকি যাদের আমরা পাঠালাম ওদের কী হবে! যেকোনও সময় রিইনফোর্সমেন্ট হতে পারে। তো তাড়াতাড়ি আমরা নৌকা নিয়ে উজানে যেতে লাগলাম। দশ মিনিটের মধ্যে হেভি ফায়ার শুরু হল। টহল দল ফিরেছে। আমরা ওখান থেকে সময়মতো ফিরে আসায় বেঁচেছি। কিছুদূর এগিয়ে আসার পর আমরা আমাদের দলের বাকিদের টর্চের মাধ্যমে সিগন্যাল দিয়ে খুঁজে পেলাম। এদের কাছ থেকেও আমরা ১২ পেটি চাইনিজ গুলি পেলাম।

আমি কোনও অপারেশন থেকে কখনও পিছিয়ে আসিনি। একশ গুণ কাজ করেছি, কিন্তু প্রচার চাইনি। বলা উচিৎ না, কাদের সিদ্দিকী এক গুণ কাজ করে একশ’ গুণ প্রচার করেছে। কাদের সিদ্দিকী বাঘা বাঙালি, প্রশ্নই আসে না। এই বই করতে, পত্রিকায় সাপ্লিমেন্ট ছাপতে টাকা কোত্থেকে আসলো! টাঙ্গাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের সোনা লুট করা হয়েছিলো, গাড়ি দিয়ে সোনা সরানো হয়েছিলো। এরকম বদনাম তো আছে। আজকের এই পরিসরে তা আর না বললেই ভালো। যুদ্ধের সময় যদি তারা ব্যাংক লুট করতেন তাহলে অন্যায় মনে করতাম না। যেখানে রাষ্ট্রের প্রশ্ন, জাতির প্রশ্ন- সেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থ আসতে পারে না।

যে কারণে যুদ্ধে যাওয়া

যুদ্ধ করতে গিয়েছিলাম দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, টাকার জন্য না, সনদপত্রের জন্যও না। আমার জন্য অনেকে আফসোস করে থাকেন- আপনি তো কিছুই পাইলেন না, বীরোত্তম দূরের কথা, বীর প্রতীকও পাইলেন না! আমি বলি- ভাইরে আমিতো যাইও নাই। জেনারেল ওসমানী আমাকে আহ্বান করেছিলেন, আমি সাড়া দিই নাই। আমার তো মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটও নাই, তবু এবার আমাকে আবার দুই থানার বাছাই কমিটির সভাপতি বানিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সুফল জাতি পাচ্ছে কি?

সুফল বিভিন্ন দিক থেকে এসেছে। বঙ্গবন্ধু সময় পান নাই। সাড়ে তিন বছর একজন শাসক একটি ভাঙ্গা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলতে পারেন না। তাকে যে যেভাবে মূল্যায়ন করুক না কেন বঙ্গবন্ধু ছাড়া এতো শিগগিরই বাংলাদেশ পৃথিবীব্যাপি স্বীকৃতি পেত না, জাতিসংঘের সদস্যপদ কিংবা জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতার অধিকার আদায় করে নিতে পারত না।

জাতির জনককে হত্যা করে আমরা সারা বিশ্বে কলঙ্কিত হয়েছি এবং সে কলঙ্কের বোঝা আজও বয়ে বেড়াচ্ছি। কতো বেশি সাহসী পুরুষ, কতো বেশি বাঙালি সমাজ জীবনের প্রতি দায়বোধ থাকলে একটা মানুষ জাতীয় নেতা হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুপরিসর আন্দোলন করতে পারে এটা প্রমাণ করেছেন বঙ্গবন্ধু।

তাকে হারিয়ে জাতি তো বেদিশা থাকবেই। আজ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলে। সাড়ে তিন বছরে ধংসস্তুপে পরিণত হওয়া একটা দেশকে গড়ে তোলা সম্ভব না। যারা ক্রিটিক তারা এটা চিন্তা করে না যে কথা বলার চাইতে দেশসেবা অনেক বেশি যন্ত্রণার, অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যার সাহস নেই তার পক্ষে মনের দিক থেকে শতধা বিভক্ত এই জাতিকে পরিচালনা করা, উন্নয়নের একটি সুনির্দিষ্ট ধারায় পরিচালিত করা কঠিন বিষয়।

আজ সাড়া জাগানো একটি ক্ষুদ্র দেশ বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক তারই মেয়ে শেখ হাসিনা। বিদেশে গেলে যে সম্মান উনি পান টাকা দিয়ে তা আনা যায় না।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!