মাটি ও নাড়ির টানে, যেতে হবে সেখানে

আমরিকায় টানা ৩ বছর কাটানোর পর প্রথম দেশে যাচ্ছিলাম। দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর।

রেজাউল হক নাঈম, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2017, 06:08 AM
Updated : 17 April 2017, 08:04 AM

টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করার সময় থেকে পরিকল্পনা ছিল, পিএইচডি শুরু করলে প্রথম সেমিস্টারেই দেশে যাব। সেই করতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেলো। এজন্য কিনতে হলো দাম দিয়ে কষ্টের ভ্রমণ। ইতিহাদ এয়ার লাইন্সে, প্রায় ৩৬ ঘণ্টার ভ্রমণ, সাথে আছে তামজীদ। গন্তব্য ঢাকা।

শিকাগো ওহেয়ার এয়ারর্পোট থেকে ম্যানচেস্টার, ৮ ঘণ্টা যাত্রাবিরতি। ম্যানচেস্টার থেকে আবুধাবি এয়ারপোর্ট, আবার যাত্রাবিরতি ৮ ঘণ্টা। তারপর আবুধাবি থেকে ঢাকা। কমল দাদা র্পাডু ভিলেজ থেকে পার্ডু মেমোরিয়াল ইউনিয়ন এক্সপ্রসে এয়ারকোচ স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে আসলেন, সাড়ে ১২টার দিকে। তারপর শিকাগো ওহারে এয়ারপোর্টে বাসে যেতে প্রায় ৩ ঘণ্টা।

ঢাকার পল্লবী-ধলেশ্বরী বাসের লাইনের মতো বিশাল লম্বা আঁকাবাঁকা লাইন, তাই ফ্লাইটের ৪ ঘণ্টা আগে আসা। চেক-ইন করতে গিয়ে অনেক বাঙালির সাথে পরিচয়। সবাই দেশে আসছেন ভিন্ন ভিন্ন এয়ারলাইন্সে। একটি বিমানের সাড়ে চারশ’ যাত্রীর মধ্যে পর পর তিনটি সিটেই যে কাকতলীয়ভাবে তিনজন বাংলাদেশি যাত্রী বসবেন, এমন কখনো ভাবিইনি।

আমার ডানে ‘বল স্টেট ইউনিভার্সিটি’র পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুন্নি বেগম, দেশে যাচ্ছিলেন কোন এক কন্ফারেন্সে যোগ দিতে আর ডানে জনৈক আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার। নানা ধরনের আলাপচারিতায় বিমানে প্রথম ১৪ ঘণ্টা খুব সহজেই কেটে গেলো। র্পূব পরিচিত ৫-৭ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সাথে দেশিয় আমেজে আড্ডায় কেটে গেল ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টের ৮ ঘণ্টার ট্রান্জটি।

ম্যানচেস্টার থেকে আবুধাবি যাবার পথে বিমানের পাশের সিটে ভ্রমণসঙ্গী দুবাইয়ের কোন এক ধন-কুবেরের ছেলে সুলাইমান। লন্ডনে কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে সে। আমাদের কয়েক ঘণ্টা আলাপচারিতার মাথায় বিমানবালা খাবার নিয়ে আসলেন, খাবার খেয়েই নিশ্চিন্ত মনে কয়েক ঘণ্টার ঘুম, তারপরই চলে আসলাম আবুধাবি এয়ারপোর্টে।

এখানে এসে মনে হচ্ছে শরীরে একটু ক্লান্তি এসেছে। চোখগুলোকে আর খুলে রাখতে পারছিলাম না। এয়ারপোর্টের সবগুলো আরামের সিট কারো না কারো দখলে। এদিক-ওদিক একটি সুন্দর সিট খুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। ফেসবুকে একটু ঢু মেরে আসতে চোখে পড়লো, আমাদের কয়েক ব্যাচ সিনিয়র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্ফামেসি বিভাগের জাইদুর রশীদ সজীব ভাই আবুধাবি এয়ারপোর্টে মিনিট কয়েক আগে ফেসবুকে চেক-ইন দিলেন। ওনাকে খুঁজে বের করে কয়েক ঘণ্টা জমপেশ আড্ডা দিলাম।

আবুধাবি এয়ারপোর্ট থেকে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য বিমানে ওঠার লাইনে দাঁড়ালাম, তখন যাত্রীদের কথাবার্তায় মনে হলো- এ বিমানের সবাই বাংলাদেশি। বিমানের কর্মকর্তারা ইংরেজিতে বলছিলেন বিমানের সিটের ওপর ভিত্তি করে তাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ক্রমধারা অনুযায়ী লাইনে দাঁড়াতে। মনে হলো- কেউ তাদের কথা বোঝেনি। যে যার মতো করে অনেকটা লোকাল বাসের যাত্রীর মতো হৈ-হুল্লোড় করে বিমানে ঢুকেই বেজায় খুশি।

অধিকাংশ যাত্রীই ইংরেজি না বোঝায় বিমানের সিট খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রায় শ’-দুয়েকেরও বেশি যাত্রীকে সিট দেখাতে গিয়ে ৪-৫ জন বিমানবালা হিমশিম খাচ্ছিলো, আমিও সাহায্য করেছিলাম আশেপাশের বেশ ক’জনকে। মাত্র ৫ ঘণ্টায় যখন ঢাকায় আসলাম, বিমানের প্রথম চাকাটি যখন মাটিতে লাগলো, তখনকার সুখের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মতো নয়।

প্রত্যেক বার দেশের মাটিতে পা দেবার সময় অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি হয়। যথারীতি যে যার মতো হৈ-হুল্লোড় করে বিমান থেকে নামছেন। প্রায় শেষ দিকে এক বিমানবালা আমাকে এসে বললেন, আমি যেন আমার সিটেই বসে থাকি। মনে মনে ভাবছি, আমার লাগেজ হয়তো এখনো আসেনি, এর বেশি কিছু ভাবিনি। এই ফাঁকে খুব আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম আমিসহ আরও একজন যাত্রী।

সাদা পোশাকে ওয়ারলেস ডিভাইসসহ দুইজন লোক এসে কোনো কথাবার্তা না বলেই আমাকে তাদের সাথে এয়ারপোর্ট থানায় যেতে বললেন। আর খুব দ্রুত হেঁটে চলছেন। আমার হাতের দু’টো ব্যাগ নিয়ে এত দ্রুত যেতে পারছিলাম না। বার বার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বললেন, থানায় গিয়ে কথা হবে।

অনেক দূর যেতে যেতে হঠাৎ লোকটি তার হাতের পাসপোর্ট দেখিয়ে বললেন, আপনি এই লোকটা না? ছবি দেখে আমি বললাম, না।

তখনই তার মনে হলো যে তারা ভুল লোককে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি আবার দৌড়ে আসলাম আমাকে এমন হেনস্থার কারণ জানতে। নিজের অধিকারে একটু চেঁচামেচি করলাম, তাদের নাম লিখে রাখলাম- শাফায়েত ও নাসের। আর সেই সুবাদে আমার উত্তেজনা থামাতে আমার হাতের ব্যাগ দু’টো নিয়ে এগিয়ে দিয়ে গেলেন নিচ তলা পর্যন্ত।

৩৬ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণের কষ্ট গায়ে লাগেনি, আর নিজের দেশের মাটিতে ১০ মিনিটের ছোট্ট একটি ঘটনায় মনে হলো কয়েক বছরের ক্লান্তি আমার শরীরে। আমেরিকায় কন্ফারেন্সে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণ, কোথাও বেড়াতে যেতে অসংখ্যবার বিমান ভ্রমণ করেছি, এহেন হেনস্থার শিকার এই প্রথম। তাও নিজের দেশের মাটিতেই। এরকম কষ্টের স্মৃতি কখনও ভুলে যাবার নয়।

তারপরও আমার দেশ, আমার মা। মায়ের কাছে না গিয়ে কি থাকা যায়? যেতে হবে সেখানে সব সময়। মাটির টানে, নাড়ির টানে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েস্ট লাফায়াতে, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!