প্রবাসী চোখ: ডাচ বাচ্চাদের সুখের আটটি অজানা কারণ

২০১৩ সালে উন্নত বিশ্বের বাচ্চাদের ওপর 'চাইল্ড ওয়েল বিয়িং ইন রিচ কাউন্টি সারভে' নামে ইউনিসেফ একটি সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় ডাচ বাচ্চারা পৃথিবীর সুখী বাচ্চাদের তালিকায় এক নম্বরে উঠে আসে।

তানবীরা তালুকদার, নেদারল্যান্ডস থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2017, 11:28 AM
Updated : 6 April 2017, 11:06 AM

সমীক্ষার পাঁচটি বিভাগের মধ্যে যে তিনটিতে তারা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে এগিয়ে থাকে সেগুলো হলো- জীবনধারণে বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা, পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা এবং আচার-ব্যবহার ও জীবন যাত্রার ঝুঁকি।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ডাচ বাচ্চারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি বাচ্চা? আমি একজন প্রবাসী মা। দীর্ঘদিন ধরে একটি ডাচ শহরতলীতে বাস করি। আমার পক্ষে ডাচ বাচ্চাদের সুখের পেছনে অন্তত আটটি গোপন কারণ খুঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন কিছু নয়।

১.

সুখী বাবা-মায়ের সন্তানরাই যে সুখী বাচ্চা হবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কারা, এ নিয়ে জাতিসংঘের প্রথম প্রতিবেদনে ডাচরা পৃথিবীর চার নম্বর সুখি মানুষদের তালিকায় ছিলো। এই ‘সুখ সূচক’ নির্ধারণে সামাজিক অগ্রগতিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, আসলে সুখী বাবা-মা মানেই সুখী বাচ্চাকাচ্চা। 

২.

ডাচ বাচ্চাদের স্কুলে প্রতিযোগিতা করার চাপ নেই। তাই তাদের মানসিক পীড়ন খুব কম। তাদের কোনও বাড়ির কাজ থাকলেও তা খুব সামান্য। স্কুলের পরে খেলার সুযোগও পর্যাপ্ত। ডাচ প্রাইমারি স্কুলে দশ বছরের নিচে বাচ্চাদের কোন বাড়ির কাজ থাকে না। তাদেরকে শুধু লিখতে ও পড়তে শেখাটা উপভোগ করতে দেওয়া হয়।

বারো বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা শেষের সময় একটি বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয় বাচ্চাদের। এটাকে সিআইটিও পরীক্ষা বলা হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বাচ্চাদের মেধা আর বুদ্ধিবৃত্তির একটা ধারণা নেওয়া হয় ।

শিক্ষাক্ষেত্রে কোন শিশু মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় না। কেতাবি বিদ্যায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয় না। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতাও নেই।

৩.

ডাচ বাচ্চারা প্রতিদিন সকালের নাস্তায় সাদা রুটির ওপর মাখন বা চকলেটের টুকরো খেতে পায়। এটা কোন সহজ কথা নয়, যেখানে পৃথিবীতে ১ বিলিয়ন শিশু দারিদ্রে বসবাস করে। ইউনিসেফ বলছে পৃথিবীতে প্রতিদিন ২২ হাজার শিশু দারিদ্রে মারা যায়।

জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে- ডাচ শিশুরা পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত সকালে নাস্তা করে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের শিশুরা এত নিয়মিত পরিবারের সঙ্গে নাস্তা করে না। সকালের এই নাস্তা খাওয়ার সাথে স্কুলে ভাল করা আর আচরণের যোগ আছে। রোজ এভাবে নাস্তা খাওয়ার কারণে পরিবারের সবার একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটানো হয়। ফলে পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয় আর স্বতন্ত্র পরিচয়ে বেড়ে ওঠাটাও সহজ হয়।

৪.

ডাচ বাচ্চাদের একটা দাদু-নানু দিবস থাকে। সপ্তাহের কর্মব্যস্ত কোন দিনে আপনি যদি ডাচ বাচ্চাদের খেলার জায়গায় যান তাহলে আপনি সেখানে একজন নানু বা দাদুর দেখা পাবেন। দেখবেন নাতি নাতনীদের নিয়ে তারা পার্কে গেছেন। অনেক ডাচ দাদুরাই তাদের নাতি-নাতনীদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দাদুর সাহচর্য শিশুর নিজের আত্মসম্মান গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

৫.

ডাচ পরিবারগুলোকে সংসার খরচের জন্য ডাচ সরকার প্রতি মাসে টাকা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে বাচ্চা বড় করা খুব খরচের ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু নেদারল্যান্ডসে তা নয়।

ডাচ পরিবারগুলো বাচ্চাদের ভাতা, বাচ্চাদের জন্য সুবিধা বৃত্তি বা বেনিফিট স্টাইপেন্ড (যেটা বাবা মায়ের আয়ের ওপর নির্ভর করে), সম্মিলিত ছাড় বা কম্বিনেশান ডিসকাউন্ট (বাচ্চাদের ডে-কেয়ার ও অন্যান্য খরচ সামলানোর জন্য করের একটা অংশ ফেরত পাওয়া) আর বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ার জন্য নিয়মিত ভাতা এসব পেতেই থাকেন।

৬.

ডাচ নারীদের আটশট্টি ভাগ খণ্ডকালীন চাকরি করেন। তারা সপ্তাহে পঁচিশ ঘণ্টা কাজ করেন। এতে করে তারা অন্য দেশের মায়েদের চেয়ে নিজের টাকায় বাচ্চাদের যত্ন নিতে ও সময় দিতে পারেন বেশি।

ডাচ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক এলেন ডা ব্রুন 'ডাচ মহিলারা কখনোই বিষন্নতায় ভোগেন না' নামে একটি বই লিখেছেন। বইটিতে তিনি লিখেন, 'ব্যক্তিগত পছন্দের স্বাধীনতাই হলো মূল চাবিকাঠি। ডাচরা তাদের পছন্দের জীবনসঙ্গী, ধর্ম ও লিঙ্গ-বৈশিষ্ট্য বেছে নিতে পারেন। যে কেউ সাধারণ মাদক ব্যবহার করতে পারে। কথা বলার স্বাধীনতা আছে। নেদারল্যান্ডস প্রকৃতই একটা মুক্তমনা দেশ।"

৭.

ডাচ বাবারা খণ্ডকালীন চাকরি দিয়ে সংসারে সাহায্য করা ও বাচ্চা প্রতিপালনে মায়েদের সমান দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ১৯৯৬ সালে ডাচ সরকার এ দেশের খণ্ডকালীন চাকরিজীবীদের পূর্ণকালীন চাকুরের সমান সুযোগ ও মর্যাদা দিয়েছে। এতে করে পুরুষরা কর্মজীবন ও ব্যক্তি জীবনের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে পেরেছেন। প্রতি তিন জনে একজন বাবা এখন এই সুযোগটি নিচ্ছেন।

নারীদের মতো অনেক বাবাই সপ্তাহের তিন দিন বা চার দিন কাজ করে বাকি একদিন সন্তানদের সঙ্গে কাটান।  'বাবা দিবস' এখন শুধু মুখের কথা নয় বরং ডাচ জীবনের একটি অংশ। ডাচ বাবারা সন্তান লালন-পালনে নিজের দায়িত্ব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন ও নিজের ভূমিকাটি সযত্নে পালন করেন।

৮.

ডাচ শিশুদের নিজেদের মতামত দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। ডাচ বাচ্চাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা হয়। যে মুহূর্ত থেকে তারা নিজেদের বাক্য গুছিয়ে বলতে শেখে, সে মুহূর্ত থেকে তারা তাদের মতামত দিতে পারে। তাদের বাবা-মায়েরা সেটা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

আমি অনেক বছর ধরেই নেদারল্যান্ডসে প্রবাস জীবন যাপন করছি। আমার স্বামী একজন উদ্যোক্তা, তার খণ্ডকালীন চাকরির কোন সুযোগ নেই। আর আমি একজন বাড়িতে থাকা মা। যাই হোক, আমরা সুখী কারণ আমরা সেভাবেই জীবনযাপন করছি যেভাবে আমরা তা করতে চাই। আমার দুরন্ত বাচ্চাটার পেছনে সারাদিন দৌড়ালেও আমি ক্লান্ত নই, এটাই ডাচ দেশে বসবাস করার প্রশান্তি।

লেখক: প্রবাসী লেখক ও ব্লগার

ছবি কৃতজ্ঞতা: তানবীরা তালুকদার

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!