প্রবাসের চিঠি: লড়াই কেবল মুসলমানের নয়, সবার

২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর সাউথ ওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের এক ফ্লাইট থেকে কয়েকজন প্যাসেঞ্জারকে নামিয়ে দেওয়া হয়, কারণ হচ্ছে তারা আরব মুসলিম।

অজন্তা দেব রায়, লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2017, 09:57 AM
Updated : 25 March 2017, 11:19 AM

তাদের সঙ্গে একই ফ্লাইটে যেতে নিরাপদ বোধ করছিলো না বলে অন্য যাত্রীরা অভিযোগ করেছিলেন। ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ে মুসলিম বিদ্বেষের ভূমিকা কতটুকু তা পুরো বিশ্ব দেখেছে। ভয়ের কথা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে এখন অহরহ সাম্প্রদায়িক বিদ্ধেষমূলক ঘটনার খবর আমরা শুনতে পাই। এর বেশির ভাগই সাধারণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে।

এই জানুয়ারিতে জেএফকে এয়ারপোর্টে এক মহিলা কর্মচারিকে লাথি মেরে ফেলে দেয় একজন লোক শুধু মুসলিম হবার কারণে। এই ঘটনাগুলো উদ্বেগের। বিশ্বব্যাপি ইসলামের নামে নাশকতা চালানো জিহাদি জঙ্গিদের কারণে সামাজিক,  রাজনৈতিক এবং বৈশ্বিকভাবে বিব্রত ও হেয় হচ্ছেন কোটি নিরপরাধ মুসলিমরা যারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে ‘জঙ্গিবাদ বা নিরপরাধ মানুষ হত্যা তাদের ধর্ম সমর্থন করে না’।  

এই অবস্থার অবসান দরকার। লন্ডন পার্লামেন্টের সামনে সন্ত্রাসী হামলাকারিও মুসলিম। কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান যে যুক্তরাজ্য একটি যৌক্তিক ও সহিষ্ণু রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র বোঝে যে একজন খুনী অপরাধীর অপকর্মের দায় পুরো গোষ্ঠীর নয়।

সে কারণে যুক্তরাজ্যে যাতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি না হয়, দেশটিতে বসবাসকারী লাখো মুসলিমের বিরুদ্ধে ঘৃণা না ছড়ায় সেজন্য হামলার পর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন, মন্ত্রী, এমপি ও লন্ডনের মেয়র সবাই আহ্বান জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের মানুষ বিশ্বাস করে এই রকম সন্ত্রাসী হামলা এখানে বিভক্তি তৈরি করতে পারবে না। ব্রিটিশ ফেইথ ফোরামের ভিন্ন ধর্মীয় নেতারাও এগিয়ে এসেছেন, সংসদে জরুরি মিটিং করেছেন, সম্প্রীতি রক্ষায় জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে।

লন্ডনের মেয়র সাদিক খানের আহ্বানে ওয়েস্টমিনস্টারে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাজারো মানুষ সমবেত হয়েছিল ট্রাফালগার স্কয়ারে। লন্ডনে কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে আসা টুরিস্ট থেকে শুরু করে লন্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা, বিভিন্ন বয়সের, ধর্মের, বিশ্বাসের মানুষ মোমবাতি ও বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে জড়ো হয়েছিল।

সবার উচ্চারণ একটাই- ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, বিভক্তির দেয়াল গড়তে দেওয়া যাবে না’। সমবেত বলিষ্ঠ উচ্চারণ- ‘লন্ডনবাসী এইসব সন্ত্রাসী হামলায় ভীত নয়’। কিন্তু এক অদৃশ্য বিভক্তির দেয়াল যে মানুষে মানুষে গড়ে উঠেছে সেটা এই সব আয়োজন, সব না বলা কথা আর অভিব্যক্তির মাঝে কোথায় যেনো স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো।

২০০৫ সালের ৭ জুলাই সন্ত্রাসী হামলার পরে যুক্তরাজ্যে এটাই সবচেয়ে বড় আঘাত। যদিও সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী হামলার কারণে যুক্তরাজ্যেও এধরণের হামলার আশংকা ছিল বহু আগে থেকেই। এর আগে দেশটির গোয়েন্দারা সফলভাবে ১৩টির বেশি সন্ত্রাসী হামলার প্লট সনাক্ত করতে পারেন, যে কারণে সেগুলো ব্যর্থ হয়।

সন্ত্রাসীদের টার্গেটের মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ব লন্ডনের জনপ্রিয় শপিং সেন্টার ওয়েস্ট ফিল্ড। এখানে প্রতিদিন অন্তত হাজার পাঁচেক মানুষ যাওয়া আসা করেন। শনি ও রোববার বন্ধের দিনে এই সংখ্যা কয়েকগুন ছাড়িয়ে যায়।

ওয়েস্ট ফিল্ডে হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সানা আহমেদ ও মহম্মদ রহমান নামে এক দম্পতির গতবছর জেল হয়। জবানবন্দিতে তারা বলেছিলেন, যে জায়গাতে হামলা করলে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে সেইরকম জায়গাই তারা বেছে নিতে চেয়েছিলো। আর সে কারণে তাদের টার্গেট ছিল ওয়েস্ট ফিল্ড। কি অসুস্থ মানসিকতা!

এইসব ঘটনা এবং সর্বশেষ ওয়েস্টমিনস্টারের সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে কয়েকটি ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে জন্ম নেওয়া, যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা তরুণ-তরুণীরা কেন ভয়ংকর খুনে জিহাদি হয়ে উঠছে, এ প্রশ্ন স্বভাবত আমাদের মনে আসতে পারে। যুক্তরাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের সুযোগ নিয়ে, বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কিছু মানুষ এই দেশের বেনিফিট সিস্টেমে থেকেও এই দেশের ধ্বংস চায়।

যে দেশ তাদের ভরণ-পোষণ দিচ্ছে, উন্নত বিশ্বের সব সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে,  নিজেদের মতো করে চলা-বলা, কাপড় পড়া ও ধর্মচর্চার অধিকার দিচ্ছে, সেই দেশের মানুষের উপর আঘাত আনার চিন্তা এরা কিভাবে করতে পারে?

আইনের শাসনের উদাহরণ হিসেবে যে যুক্তরাজ্যকে ধরা হয়, তারা সেই আইনে সন্তুষ্ট না থেকে এখানে কেন ইসলামি শরিয়া আইন চায় ?  যদি শরিয়া আইনই চাইবে তাহলে কেন তারা এই দেশে আছে? কেন তারা আরবের কোনো দেশে যেখানে সেই আইন আছে সেখানে গিয়ে থাকছে না? কেন এই দেশকে বদলাতে চাইছে?

এই প্রশ্নগুলো করাটা সহজ হলেও এর উত্তর অনেক জটিল। আমার মতে, যুক্তরাজ্যের সরকার যদি সব তথাকথিত মৌলবাদী জিহাদি আদর্শ প্রচারকারিদের সঙ্গে ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ আচরণ করতো তাহলে হয়তো অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। সমস্যা হচ্ছে যুক্তরাজ্য সত্যিকার অর্থেই বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কারো বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছে বা উগ্র উষ্কানিমূলক কিছু পাচ্ছে, তারা কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

আর এই সাম্প্রতিক হামলাগুলোর প্লট সনাক্ত করা আসলে দুরূহ ব্যাপার। কারণ অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ষড়যন্ত্র করলে কাউকে সহজে ধরে ফেলা যায়। কিন্তু কোন মানুষ তার মাথায় জিহাদি চিন্তা নিয়ে ঘুরছে সেটাতো আর ট্র্যাক করা যায় না।

আমার ধারণা, অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে এই তথাকথিত ব্রিটিশ জিহাদিরা আসলে আত্মপরিচয়হীনতায় ভোগে। কারণ এদের প্রায় সবাই ইমিগ্রান্ট ব্রিটিশ। জন্ম থেকে এরা না পারে নিজের বাবা মায়ের জন্মভূমির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত ভাবতে,  না পারে পুরোপুরি ব্রিটিশ ভাবতে। তখনি তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে।

সব পরিচয় ছাপিয়ে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় তাদের মূল পরিচয়, ধর্মের নামে এদের ব্রেন-ওয়াশ করা সহজ হয়ে যায়। আবার অনেকের অবস্থা ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলায়’ টাইপ। অ্যাডভেঞ্চার খুঁজতে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। প্রেমে ব্যর্থ, জীবনে ব্যর্থ, অসফল মানুষগুলোকে জীবনের একটা অর্থ দেওয়ার হাতছানি দিয়ে,  মৃত্যুর পর বেহেস্তে যাবার লোভ দেখিয়ে ইসলামিক স্টেট সহজেই এদেরকে রাডিক্যালাইজ করতে পারে।

আশার কথা হচ্ছে এদের সংখ্যা বেশি নয়। অধিকাংশ মানুষ শান্তিকামী এবং এধরণের সন্ত্রাসী ঘটনার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, যখন এধরণের সন্ত্রাসী হামলায় হামলাকারীর নাম হিসেবে কোনো মুসলমানের নাম আসে, তখন সবচেয়ে বেশি লজ্জায় পড়েন এদেশের মুসলিম অধিবাসীরা। তাদের জন্য বিব্রতকর অবস্থার তৈরি হয়। কারণ এই জিহাদিরাও নিজেদের ‘মুসলিম’ দাবি করে এবং ‘ইসলামের’ নামে হামলা করছে বলে প্রচার করে।

এ কারণে অনেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার হন। সেই ৯/১১ হামলার পর থেকে আমরা দেখেছি শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অনেকে ইউরোপ-আমেরিকার ভিসা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। অনেকে বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন।

এ ধরণের হামলার পর সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শোনা যায় তা হচ্ছে, ‘এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।’ খেয়াল করে দেখবেন, এই কথা বলা হচ্ছে আবার একই সঙ্গে ধর্মীয় গুরু ও  ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সভা করা হচ্ছে। ধর্মের যদি কোনো সম্পর্ক নাই থাকতো তাহলে ‘ধর্ম’ শব্দটাই এখানে ব্যবহৃত হতো না। এই ধরণের হামলার সঙ্গে ‘ধর্মের’ সম্পর্ক আছে। আর সেটা হচ্ছে এই সন্ত্রাসীগুলো ‘ধর্মের’ নামে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে এবং দাবি করছে তারাই ওই ধর্মীয় আদর্শের প্রকৃত অনুসারি।

আর সে কারণে ইসলামের নামে এধরণের হামলা ঠেকানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়াটা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য সবচাইতে জরুরি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে অনেক বেশি। এতো কিছুর পরও যুক্তরাজ্যের সরকার যেভাবে অভিবাসীদের ভরসা করছে, সেই ভরসা রক্ষায় মুসলিম কমিউনিটি নেতাদের এগিয়ে আসা উচিত।

‘জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই’  অথবা ‘জঙ্গিরা প্রকৃত মুসলমান নয়’ এই বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না। লাখো শান্তিকামী সাধারণ মুসলিম যে আদর্শে বিশ্বাস করেন বলে তারা দাবি করেন, সেই আদর্শের প্রচার করতে হবে আরো বেশি। সভা সেমিনার করে বিপথগামী তরুণদের কাছে মানবতার আদর্শ পৌঁছে দিতে হবে।

যে কারণে ‘ইসলাম’কে শান্তির ধর্ম বলছেন সেই কারণের প্রচার করতে হবে। জিহাদি আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকেই। তা না হলে এভাবে কোন অপরাধ না করেও অপরাধীর তকমা লাগতে থাকবে আপনাদের গায়ে। আর আমি নিশ্চিত, এমন উদ্যোগ নিলে পাশে পাবেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী শান্তিকামী প্রতিটি মানুষকে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুধু মুসলমানদের নয়, আমাদের সবার। চলুন সবাই একসঙ্গে লড়ি। আশা করি একদিন এই অন্ধকার চিরতরে দূর হবে। আলোর অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সদস্য

ই-মেইল: ajanta_dream@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!