প্রবাসের চিঠি: উড়োজাহাজে চড়ে বাবার স্বপ্নের পথে

বাবা প্রত্যেক মানুষের মাথার ওপর ছায়ার মতো। বাবা এক পরম আশ্রয়, যার হাত ধরে পাড়ি দেওয়া যায় বিপদসঙ্কুল সমুদ্র।

নাঈম হাসান পাভেল, পর্তুগালের সিনত্রা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2017, 08:24 AM
Updated : 17 March 2017, 12:27 PM

বাবা মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক শক্তি আর সামাজিক পরিচয়। বাবাকে হারালে শুধু বাবার ভালোবাসা হারায় না, সেইসঙ্গে হারিয়ে যায় এই সবকিছুই।

বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো আমি যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাবো, অনেক বড় হবো জীবনে। বাবার স্বপ্নের সাথে মিল রেখে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই আমার বিদেশ পাড়ি দেওয়ার সংগ্রাম। বাবার স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্র না হলেও বছরখানেক আগে বাবার স্বপ্নগুলো নিয়ে আমার ডেনমার্ক যাত্রা। অনেক খুশি হয়েছিলেন বাবা-মা।

প্রবাসের প্রতিটা কষ্টের প্রহর আমি মেনে নিয়েছি শুধু বাবার স্বপ্নগুলোকে সামনে রেখে। আমার অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু বাবা-মায়ের কথা মনে করে সব মেনে নিয়েছি, মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু বিদেশে আসার এক বছর না যেতেই কেন আমার জীবনের গল্পটা এমন হয়ে গেলো!

একুশ বছর বয়সেই পাহাড়সম যন্ত্রণা নিয়ে প্রবাসের জীবনটা আমার বিষিয়ে উঠবে কল্পনা করিনি। এইতো সেদিন ২০১৬ সালের জানুয়ারির ২৮ তারিখ, বাবা আমাকে বিদায় দিতে এলেন এয়ারপোর্টে। আমার হৃদয়ের ভাঙ্গচুর কেবল আমি টের পেয়েছি, কাউকে বুঝতে দেইনি।

বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ভালো থাকিস, নিজের যত্ন নিস। নতুন দেশে একটু সাবধানে চলাফেরা করিস।” এরপর কিছুদূর গিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাবা চোখ মুছছেন। তখন আর কান্নাটা ভেতরে রাখতে পারিনি।

মনে মনে কল্পনা করলাম, পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফেরার সময় এয়ারপোর্টে অপেক্ষমাণ বাবাকে দূর থেকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরবো। বাবা যে কত খুশি হবেন আমাকে দেখে! কল্পনায় বিদেশ থেকে ফিরছি মনে মনে, নিজেই নিজেকে সান্তনা দিচ্ছিলাম।

ভাবছিলাম, একসাথে অনেক কথা বলবো বাবাকে, বিদেশের গল্প শোনাবো। কিন্তু কেন এমন হলো, বাবা আমার ফিরে আসা পর্যন্তও অপেক্ষা করলেন না, আহা আমার অভিমানী বাবা!

গেলো দুইটা ঈদের দিন আমি উপলব্ধি করেছি, বাবা-মা’কে ছাড়া ঈদ পালন করা কতো কষ্টের। সকাল থেকে মন খারাপ। বাবাকে ফোন দিয়ে কাঁদছিলাম, আর মনে মনে স্বপ্ন আঁকছিলাম পরের ঈদটা বাবা-মা'র সঙ্গেই যেন করতে পারি। কিন্তু সে সৌভাগ্য আর আমার হয়নি। একুশ বছর বয়সেই আমি পিতার আদরশুন্য যুবক হয়ে গেলাম!

বাবা যখন অসুস্থ আর গায়ে ভীষণ জ্বর, আমি ফোন করে কাঁদছিলাম।

বাবা আমাকে ধমকে বললেন, “শুধু শুধু কান্না করিস কেন? আমার এমন কিছু হয়নি।”

বড় ছেলে হিসেবে ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা দারুণ ছিলো। বাবার বিশ্বাস ছিলো, তাই আমার উপর ভরসা করেই বাবা নিজের স্বপ্নগুলো আমার কাছেই নির্দ্বিধায় বলতেন। এখানে আসার পর প্রায়ই বলতেন, “পাভেল তুই আমার বড়ছেলে। আমার ছেলেদের তুই একটু দেখে রাখিস।”

আমি বাবাকে হতাশ করতাম না, সবসময় বাবাকে সাহস দিতাম। বলতাম, “আপনার ছেলে তার সারাজীবন উৎসর্গ করে হলেও আপনার স্বপ্নগুলো সত্যি করবে।”

আমার স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে সাংবাদিক হবো। কিন্তু বাবার এটা পছন্দ না, তাই আমাকে সাংবাদিকতায় ভর্তি হতে দেননি। পরে বাবার স্বপ্নের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে আমার স্বপ্নগুলো ভুলেছিলাম। পুরোদমে বিদেশ পাড়ি দিলাম। এটা বাবার স্বপ্ন, বাবার চাওয়া।

স্বপ্ন ছিলো আমার যখন মোটামুটি টাকা হবে,  আমি বাবা-মা’কে নিয়ে হজ্ব পালন করবো। আল্লাহ আমার মনের এই আকাঙ্ক্ষাগুলো পরিপূর্ণ করলেন না। একবার বাবাকে আমার দাদার জন্য খুব কাঁদতে দেখলাম। সেদিনই প্রথম বাবাকে প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। আর আজ আমি আমার বাবার জন্য কাঁদছি।

তুমি কোথায় বাবা? আরেকটিবার আসো না আমার মাথার উপরে বিশাল আকাশ হয়ে! আসো না বাবা অল্পক্ষণের জন্য, একটিবার বাবা বলে ডাকি- আমার বাবা।

লেখক: শিক্ষার্থী, কোপেনহেগেন বিজনেস কলেজ, ডেনমার্ক

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!