ভয়েস অব আমেরিকার বর্ষপূর্তিতে বাঙালির মিলনমেলা

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি আন্তর্জাতিক রেডিও ও টেলিভিশন সম্প্রচার সেবা 'ভয়েস অব আমেরিকা' তাদের ৭৫তম বর্ষপূর্তি পালন করেছে।

আকবর হায়দার কিরন, নিউ ইয়র্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2017, 12:12 PM
Updated : 6 March 2017, 05:53 AM

বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে ভিওএ এর মূল অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এই বর্ষপূর্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশি ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা অংশ নেন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যোগ দেবো বলে ভিন্ন ধরনের অনুভূতি কাজ করছিল বেশ কিছুদিন ধরে। রোকেয়া হায়দার আপা তাগিদ দিচ্ছিলেন। ভিওএ পরিচালক আমান্দা বেনেটের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে আন্তরিকভাবে ফলোআপ করছিলেন শেগোফতা নাসরিন আপা।

আমার সঙ্গে অফিসিয়ালি নিহার সিদ্দিকী, মিনহাজ আহমেদও পুলক মাহমুদ যাচ্ছেন বলে আমার আনন্দ লাগছিলো। উৎসবে যোগ দিতে আসবেন বেতার কিংবদন্তী কাফি খান, ইকবাল আহমেদ, ইকবাল বাহার চৌধুরী, দিলারা হাশেম, মাসুমা খাতুন, জিয়াউর রহমান। তাদের নিয়ে আমাদের সাংবাদিকতা জীবনের মহামূল্যবান স্মৃতি রচনা করবো বলে আমি আর নিহার ভাই সারাক্ষণ প্লান-প্রোগ্রাম করছিলাম।

আগে থেকেই সরকার কবির ভাই বলে রেখেছিলেন ১ মার্চের ‘হ্যালো ওয়াশিংটন’ হবে ৭৫তম বার্ষিকী নিয়ে এবং আমাকে প্যানেলের একজন হিসেবে ৪৫ মিনিটের লাইভ অনুষ্ঠানে থাকতে হবে।

মিনহাজ ভাই বলে দিয়েছেন দুপুর ঠিক দেড়টায় আমাদের ওয়াশিংটন যাত্রা করতে হবে। তাই বেলা সোয়া এগারোটা থেকে ভিওএ লাইভে থাকতে পারলাম নিশ্চিন্তেই। সঙ্গে যোগ দিলেন নিউ ইয়র্ক থেকে মোহাম্মদ উল্লাহ ভাই ও ক্যানবেরা থেকে ড. শফিক।

সরকার কবির ভাইয়ের সঙ্গে স্টুডিয়োতে ছিলেন রোকেয়া আপা, শেগোফতা আপা ও অতিথি জেবুন্নাহার লিলি। কথার এক পর্যায়ে স্মরণ করলাম অকালপ্রয়াত ইশতিয়াক আহমেদ ভাই, গিয়াস কামাল ভাই, খন্দকার রফিকুল হকসহ অন্যদের।

আরও স্মরণ করলাম আমাদের ভিওএ ফ্যানক্লাব এর অন্যতম উদ্যোক্তা অকালপ্রয়াত জামান সিদ্দিকি এবং বর্তমান দুই প্রধান কাণ্ডারি মুনির আহমেদ ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ভাইকে।

গিয়াস কামাল ভাই সবসময় আমাদের কাছে ছিলেন ফ্যানক্লাবের অভিভাবক। ভিওএ থেকে কেউ ঢাকা গেলেই তার সহযোগিতায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আমরা প্রীতি-সম্মিলন করার সুযোগ পেতাম। ইউসিসের বাচ্চু ভাই, হাই খান ভাই- এদের কাছে রয়েছে আমাদের জীবনের অনেক ঋণ।

রোকেয়া আপা, ভিওএ’র ফকির সেলিম ও শিব্বির আহমেদ বারবার জানতে চাচ্ছিলেন আমরা কখন রওনা করছি। রোকেয়া আপা মজা করে বলছিলেন, তোমাদের জন্যে বিরিয়ানির ব্যবস্থা করেছি। সাধারাণত ওয়াশিংটন গেলে থাকা হয় শিব্বির ভাই কিংবা সেলিমের বাসায়। কিন্তু দল ভারি বলে হোটেলে বুক করা হয়েছে সেলিমের বাড়ির কাছেই।

ফকির সেলিমের পাশাপাশি আমাদের তাওহিদও অপেক্ষা করছিলেন কখন দেখা হবে। হোটেলে চেকিং করে এবার যাত্রা শুরু সেলিমের নতুন বাড়ির দিকে। গিয়ে দেখা গেলো মাত্র দু’দিন আগে তিনি এই বাড়িতে উঠেছে, চারদিকে বাক্স-পেটরার ছড়াছড়ি। সবাই মিলে খেতে গেলাম এক টিজিআই ফ্রাইডেতে।

সেলিম কানে কানে বললেন, ২৯ ফেব্রুয়ারি তার বৌ অনুর জন্মদিন। খবরটা শুনেই নিহার ভাইয়ের বিশেষ তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। ঠিক হয়ে গেলো ডিনার শেষে নিয়ে আসা হবে বিশেষ কেক এবং অনুকে দেওয়া হবে বিগ সারপ্রাইজ।

বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলে রাতেরবেলা নামকা ওয়াস্তে ঘুমালাম। একমাত্র নিহার কী চমৎকার নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন! আমি রাত চারটার দিকে শাওয়ার করে ভোরে ডিসির দিকে যাবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সারারাত ফেসবুকে জেগে থাকা পুলককে বললাম, আমাকে অনুসরণ করতে। সুবোধ বালকের মতো আমরা সবাই সকাল আটটার ভেতর চেক-আউট সেরে হোটেলের ব্রেকফাস্ট রুমে পৌঁছে গেলাম।

ভিওএর সামনে এসে ছবি তোলা, টিভি প্রোগ্রামের জন্য ভূমিকা রেকর্ড করা শেষে ফকির সেলিমের সঙ্গে ভেতরে গেলাম। এই প্রথম ভিওএ ভবনে ঢুকতে প্রথা অনুযায়ী কোন চেক হলো না, কারণ আমাদের নাম ভিওএ পরিচালকের বিশেষ গেস্ট-লিস্টে ছিল।

বিশাল ভিওএ ভবনের ভেতরে ঢুকতেই উৎসবমুখর এক পরিবেশের মুখোমুখি হলাম। নিহার ভাইয়ের ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাংলা বিভাগের স্টুডিয়োতে ঢোকার পথেই দেখা হয়ে গেলো ভিওএ দক্ষিণ ও কেন্দ্রিয় এশিয়া বিভাগের পরিচালক আকবয় আয়াজের সঙ্গে।

রোকেয়া আপা তখনো আসেননি। কিন্তু আজকের ট্রান্সমিশন নিয়ে ব্যস্ত সেলিম ও তৌহিদ। ভিওএর করিডোরে অন্যান্য বিভাগের পাশাপাশি বাংলার স্টল সাজাতে হাত লাগালাম সবাই মিলে। নিহার ভাই এই পর্বে ফেসবুক লাইভ করলেন বাংলা বিভাগ এবং এই ৭৫তম উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে। ঢাকা ভিওএ ফ্যানক্লাবের পক্ষে সাংবাদিক তানবির সিদ্দিকি আমার হয়ে রোকেয়া আপাকে যে আজীবন সম্মাননা ক্রেস্ট দিয়েছিলেন সেটিও রয়েছে দেখে খুব ভালো লাগলো।

আমরা যখন এদিক ওদিক হৈচৈ করে বেড়াচ্ছি, তখন একে একে এসে পৌঁছলেন কাফি খান, ইকবাল আহমেদ, মাসুমা খাতুন, ইকবাল বাহার চৌধুরী, জিয়াউর রহমান, দিলারা হাশেমসহ অন্যরা। সরকার কবির ভাই, কাফি ভাই ও ইকবাল আহমেদ ভাই কাঁধে হাত রেখে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন। কি অসাধারণ দৃশ্য!

মাসুমা খাতুন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন ৩৫ বছর আগে ঢাকায় এক ভিওএ সমাবেশের একটি বড় পোস্টার। এতে রয়েছে প্রয়াত অধ্যাপক কবির চৌধুরী, লায়লা আরজুমান্দ বানুসহ বিখ্যাত মানুষের আটোগ্রাফ।

সকাল এগারটায় ভিওএর মূল আডিটোরিয়ামে আয়োজিত হবে অনুষ্ঠান। বাংলা বিভাগ থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। চারদিকে ‘ভিওএ ৭৫’ লেখা লালরঙের ছড়াছড়ি, অনুষ্ঠানমালা সম্বলিত ছোট ফোল্ডারটির রঙও লাল। বাংলা বিভাগের অতিথিরা ও আমরা বসলাম একেবারে সামনের দিকে।

সবাই বসেছি, কিন্তু রোকেয়া আপার বসবার কোন ফুসরত নেই। ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূতকেও দেখা গেলো। তিনি অবশ্য আমার কিংবা নিহার ভাইয়ের কাছে অচেনা, কারণ নিউ ইয়র্কের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে তিনি কখনো আসেননি। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই রোকেয়া আপা পরিচয় করিয়ে দিলেন আমান্দা বেনেটের সঙ্গে।

বাংলা বিভাগকে উপস্থাপন করতে রোকেয়া আপা কাফি খান ভাইকে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন। সারা অডিটোরিয়াম জুড়ে এক অসাধারণ পরিবেশ তৈরি হলো। পাশে রোকেয়া আপাকে নিয়ে তিনি যখন সংক্ষেপে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলছিলেন তখন পেছনের বিশাল পর্দায় ছিলো শহীদ মিনারের ছবি। কাফি খান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়েস অব আমেরিকায় কর্মরত ছিলেন।

ভিওএ বাংলা বিভাগের তাহিরা কিবরিয়া অনু ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটির সাথে তার চমৎকার নাচ দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলেন। এরপর ‘ভিওএ ৭৫’ লেখা বাংলা বিভাগের প্ল্যাকার্ড নিয়ে সবার সঙ্গে যোগ দিলেন সাবরিনা চৌধুরী ডোনা। উর্দু বিভাগের প্রধান কর্তা মঞ্চ থেকে নেমে আমার কাছে বসলেন। তার সঙ্গে সরকার কবির ভাই একেবারে খাঁটি বাংলায় কথা বলছেন শুনে কিছুটা অবাক হলাম। কবির ভাই পরিচয় করিয়ে দিতে জানা গেলো তিনি ঢাকায় ডিআইটি ভবনে কাজ করতেন।

আমান্দা বেনেট অনুষ্ঠানে উপস্থিত ভিওএর চারজন প্রাক্তন পরিচালককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অনুষ্ঠানে আমেরিকান মুল্যবোধ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন দক্ষিণ ও কেন্দ্রিয় এশিয়া বিভাগের পরিচালক আকবর আয়াজি। যখন মূলমঞ্চে বক্তৃতা এবং ভিডিও দেখানো হচ্ছিল, তখন একপাশে রাখা ক্যানভাসে ছবি আঁকছিলেন ভিওএ কুরডিশ বিভাগের লুকমান আহামেদ। সাথে পরিবেশিত হচ্ছিল এরিক ফেল্টনের লাইভ মিউজিক।

আমান্দা বেনেটের পরিচালনায় ‘টেলিং আমেরিকান স্টোরি’ প্যানেলে ছিলেন পার্সিয়ান বিভাগের লিলি সোলতানি, সোমালি বিভাগের হারুন মারুফ, নিউজ সেন্টারের ক্যাথলিন স্ট্রাক, রাশান বিভাগের নাতাশা মজগভায়া এবং বিভাগিয় পরিচালক আকবর আয়াজি। পুরো অনুষ্ঠানমালার শিরোনাম ছিলো '’ভিওএ ৭৫ ম্যানি ইয়ার্স ম্যানি স্টোরিস’।

কোন কর্মসূচিতে বর্তমান রাজনীতি বা প্রশাসনের কোনরকম উপস্থিতি কিংবা উল্লেখ ছিলো না। তবে প্রেসিডেন্ট বুশ ( জুনিয়র) এর ভিওএ সম্পর্কিত একটি মন্তব্য এতে স্থান পায়। তাছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের বাণীটি ছিলো উল্লেখযোগ্য, এতে তিনি নিজেকে ভিওএ’র ‘এক বড় ভক্ত শ্রোতা’ হিসেবে প্রকাশ করেন।

মূল অডিটোরিয়াম থেকে করিডোরে প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে একটু একটু করে এগিয়ে আবার ফিরে এলাম বাংলা বিভাগের প্রদর্শনীতে। আহসানুল হক, আবু রুমি, শিব্বির আহমেদ, আকতার হোসেন, মিনহাজ আহমেদ, শেগোফতা আপা, ডোনা, সেলিম, তৌহিদ - আমরা সবাই গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলাম ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’।

রোকেয়া আপা কাছাকাছি আসতে তাকেও টেনে নিয়ে এলাম। তখন আমরা সবাই বাংলাদেশকে ভালোবেসে হয়ে যাই একেকজন সংগীতশিল্পী। নিহার ভাই ও পুলক যথারীতি সব ধারণ করছিলেন। এই সময় বিশেষ আকর্ষণ ছিল আমাদের গানের সাথে তাহিরা কিবরিয়ার চমৎকার নাচ। দক্ষিণ ও কেন্দ্রিয় এশিয়ার দিকে দেয়ালে প্রদর্শিত হচ্ছিল বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠানের ভিডিওচিত্র।

আসছে অক্টোবর ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগের ৬০ বছর পূর্তি হবে। তারই এক মহড়া হয়ে গেলো ২ মার্চ ৭৫ বছর উৎসবে এ আসা অতিথিদের নিয়ে। বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ইশতিয়াক আহমেদের স্ত্রী, সস্ত্রীক কাফি খান, সস্ত্রীক প্রাক্তন প্রধান ইকবাল আহমেদ ও ইকবাল বাহার চৌধুরী, জিয়াউর রহমান, দিলারা হাশেম, মাসুমা খাতুন, ওয়াহেদ আল হোসেনী- এরা কেউই আজ আর বাংলা বিভাগে নেই। কিন্তু বাংলা বিভাগের প্রতি তাদের ভালোবাসা এখনো অম্লান।

প্রত্যেকের কথায় ও স্মৃতিচারণে ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। আমাদের সবার এই ছোট জীবন অনেক সমৃদ্ধ হলো এই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে। মিলনমেলা ছেড়ে আসতে মন কিছুতেই চাইছিলো না। কিন্তু স্মৃতির মনিমালা বুকে নিয়ে আমাদের আবার যাত্রা শুরু হলো, নিজের শহর নিউ ইয়র্কের দিকে।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!