আমার চোখে রাইন কার্নিভাল

রাইন নদীর ধারে গড়ে ওঠা শহরগুলোকে একসঙ্গে বলে ‘রাইনল্যান্ড’৷ সেই রাইনল্যান্ডেরই উৎসব হলো কার্নিভাল

অমৃতা পারভেজ, জার্মানির বন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2017, 11:10 AM
Updated : 25 Feb 2017, 11:10 AM

আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় আগের বছরের ১১ নভেম্বর যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ‘রোজেন মোনটাগ’ বা গোলাপি সোমবারে৷

২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি৷ শুরু হয়েছে কার্নিভালের মূল অনুষ্ঠান৷ এই দিনটিকে বলা যেতে পারে কার্নিভালের 'প্রমীলা দিবস'৷ মেয়েরাই এদিন সর্বেসর্বা৷ তারা চাইলেই কেটে নিতে পারেন অন্য পুরুষদের টাই৷

আর পেতে পারেন তাদের চুম্বন৷ ডয়চে ভেলের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান গ্রেহেম লুকাস অবশ্য সেদিন ভয়ে টাই পরেই আসেননি৷ এদিন প্রথা মেনে সকাল ১১টা ১১ মিনিটে শহরের মেয়রের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে টাউন হল দখল করে নিয়েছিলেন নারীরা৷ অবশ্য বিনা উৎপাতেই চাবি দিতে প্রস্তুত হয়ে বসেছিলেন মেয়র৷

শুধু যে শহরই মেতেছে তা নয়৷ ডয়চে ভেলের বন কার্যালয়ে কার্নিভাল ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি৷ দুপুর সাড়ে ১২টায় ডয়চে ভেলের হলরুমে জড়ো হতে থাকে নানা বয়সের মানুষ৷ অফিসের অনেকেই অনেক রকম সাজে এসেছিল সেদিন৷ গান-নাচের পাশাপাশি ছিল খাবার ও পানীয়৷ অফিসের প্রায় সবার সাথে নেচেছিলেন ডয়চে ভেলের মহা পরিচালক পেটার লিমবুর্গ৷ ডয়চে ভেলের সাফল্য কামনা করে দিয়েছিলেন বক্তব্য৷

এর পরদিন রাতেও কোলনে গিয়েছিলাম৷ সেখানে গিয়ে দেখি রাত সাড়ে নয়টায় পুরো শহরের মানুষ ভূত সেজেছে৷ কেউ ভ্যাম্পায়ার, কেউ ড্রাকুলা, কেউ বা খুবই সাধারণ ভূত৷ কারো জামায় লোগো ‘গোস্ট হান্টার', অর্থাৎ তারা ভূত-তাড়ানোর দল৷ কেন এই সাজ? জানতে চাইলে তাঁরা জানালেন যে, ওরা মনে করে সমাজ থেকে 'অশুভ সব শক্তি'কে ভূত তাড়ানোর মতো করেই তাড়াতে হবে৷

১৫ ফেব্রুয়ারি রোববার ছিল ছোটদের উৎসব৷ এদিনও সকাল সাড়ে ১১টায় কোলনে উপস্থিত হয়েছিলাম৷ সাজ যে কত বিচিত্র হতে পারে, তা এই কার্নিভালে না গেলে বুঝতাম না৷ পাকা মিষ্টি কুমড়ো সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট শিশুরা৷

ফল, পাখি, মাছ, বিড়াল, গরু, মোরগ, গরিলা – কী না সেজেছে তারা৷ কেউ বা সেজেছে পোকামাকড়৷ আবার কিছু ছেলে-মেয়ে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সদস্য সেজে ঘোরাফেরা করছিল৷ আমি অন্তত ৫০টি দলের প্যারেড দেখেছিলাম৷ কিন্তু হঠাৎ ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় বিকেল চারটায় ফিরে এসেছিলাম বন-এ৷

এর পরদিন রোজেন 'মোনটাগ' অর্থাৎ 'গোলাপি সোমবার'৷ বন-এর রাস্তায় বের হতেই চোখে পড়ল নানা পোশাক পড়া মানুষ৷ কোলনে পৌঁছালাম সোয়া ১১টায়৷ কোলনে গিয়ে ট্রামে উঠেও চোখে পড়ল একই দৃশ্য৷ বিচিত্র সাজে সেজেছেন নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই৷ কোলনের প্রধান স্টেশনে পৌঁছাতেই কানে এলো উদ্দাম ব্যান্ডের শব্দ৷

দু'ধারে বিশাল ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে৷ মাঝখানটা খালি রাখা হয়েছে প্যারেডের জন্য৷ এক একটি দল যাচ্ছে আর দর্শকদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিচ্ছে চকলেট, কখনও গোলাপ, লিলি, আরো কত হরেকরকম ফুল৷ আর সবাই একসাথে বলে উঠছে ‘আলাফ'৷ বাদক দলের সাথে নেচে উঠছেন সবাই৷ এ যে আমাদের পহেলা বৈশাখের চারুকলার শোভাযাত্রা৷ যদিও সেখানে এমন চকলেট ছোড়ার কোনো নিয়ম নেই৷

পুরো শহর ফাঁকা, যত ভিড় সব ক্যাথেড্রালের আশপাশে, অর্থাৎ কোলনের প্রধান স্টেশনের কাছে৷ সবার গন্তব্যই এক৷ সবাই ছুটছে সেদিকে৷ কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই৷ কী আনন্দ সবার চোখে মুখে!

রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানশালাগুলোতে ভিড় উপচে পড়ছে৷ শহরও যেন সেজেছে কার্নিভালের সাজে৷ আমি ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে এগুতে থাকি৷ একটি জায়গায় দাঁড়াই ভালোভাবে ছবি তোলার জন্য৷ চকলেটের তোয়াক্কা না করে ছবি তুলে যাচ্ছি৷

আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আসলেই বয়সের কোন সীমা নেই৷ সবাই যেন সেই ছোটবেলায় পৌঁছে গেছে৷ ৬০-৭০ বছর বয়সী নারী-পুরুষ যেন ৮-১০ বছরের শিশু৷ এত উচ্ছ্বাস, এত আনন্দ৷ কোথাও কোথাও দেখলাম স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের৷ তারা তাদের দল নিয়ে নিজেদের মতো করে মজা করছে৷

প্যারেডে এক-একটি দল এক একটি থিম বেছে নিয়েছিল৷ কোনো দলের সদস্যরা পৌরাণিক চরিত্র সেজেছিল৷ কেউ বা আইফোন, আবার কেউ কেউ নানা ধরনের যন্ত্রপাতি৷ অনেকেই সেজেছিল ভাঁড়৷ ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেলাম কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্যই নানা সাজে সেজে এখানে উৎসবে যোগ দিয়েছে৷

তবে কার্নিভাল যে গোটা জার্মানিতে পালন করা হয় – তা কিন্তু নয়৷ শুধু রাইন নদীর ধার ঘেঁষেই এই উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়৷ কোলন, বন ছাড়াও ড্যুসেলডর্ফ এবং মাইনৎস শহরেও কার্নিভালের পরশ লাগে৷

এছাড়া এত মানুষের ভিড়ে যেন কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা কিংবা দুর্ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল৷ ছিল সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ স্বেচ্ছাসেবী ও নিরাপত্তা দপ্তরের সদস্যরাও৷

তবে কেবল যে জার্মানির মানুষই উৎসবে যোগ দিয়েছেন, তা কিন্তু নয়৷ সেখানে গিয়ে শুনতে পেলাম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন কেউ এসেছেন ইটালি থেকে, কেউ বা লুক্সেমবুর্গ থেকে, কেউ বা ফ্রান্স থেকে৷

আসলে কার্নিভাল অনেকটা আমাদের বর্ষবরণ উৎসবের মত৷ যেখানে মানুষ ভুলে যায় সমস্ত ভেদাভেদ৷

শোভাযাত্রা শেষ হওয়ার কথা বিকেল পাঁচটায়৷ কিন্তু দুইটার সময় ভিড় ঠেলে ট্রেন স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকি৷ স্টেশনে যাওয়ার একটি পথই আমার চেনা৷ কিন্তু সব দিকে কেবল মানুষের মাথা চোখে পড়ছিল৷ মূল রাস্তার মধ্যেখানে ব্যারিকেড দেওয়া এবং সেখান দিয়ে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না৷

অবশেষে প্রায় এক ঘণ্টা পুরো পথ ঘুরে ঘুরে শেষে ৫ নম্বর ট্রাম নিয়ে কোলন স্টেশনে পৌঁছে দেখি, যে ট্রেনে যাব সেটি এই মাত্র চলে গেল৷ পরের ট্রেন ৩টা ২৯ মিনিটে....কি আর করা? তাই সেই ট্রেন ধরেই অবশেষে সোয়া চারটায় বন স্টেশনে পৌঁছালাম প্রচণ্ড ক্লান্তি আর বর্ণিল কিছু স্মৃতি নিয়ে৷

(চলবে)...

লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়চে ভেলে, বাংলা বিভাগ

ইমেইল  amrita.modak81@gmail.com

অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ-বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের পাঠিয়ে দিন। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন।  probash@bdnews24.com