আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় আগের বছরের ১১ নভেম্বর যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ‘রোজেন মোনটাগ’ বা গোলাপি সোমবারে৷
২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি৷ শুরু হয়েছে কার্নিভালের মূল অনুষ্ঠান৷ এই দিনটিকে বলা যেতে পারে কার্নিভালের 'প্রমীলা দিবস'৷ মেয়েরাই এদিন সর্বেসর্বা৷ তারা চাইলেই কেটে নিতে পারেন অন্য পুরুষদের টাই৷
আর পেতে পারেন তাদের চুম্বন৷ ডয়চে ভেলের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান গ্রেহেম লুকাস অবশ্য সেদিন ভয়ে টাই পরেই আসেননি৷ এদিন প্রথা মেনে সকাল ১১টা ১১ মিনিটে শহরের মেয়রের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে টাউন হল দখল করে নিয়েছিলেন নারীরা৷ অবশ্য বিনা উৎপাতেই চাবি দিতে প্রস্তুত হয়ে বসেছিলেন মেয়র৷
শুধু যে শহরই মেতেছে তা নয়৷ ডয়চে ভেলের বন কার্যালয়ে কার্নিভাল ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি৷ দুপুর সাড়ে ১২টায় ডয়চে ভেলের হলরুমে জড়ো হতে থাকে নানা বয়সের মানুষ৷ অফিসের অনেকেই অনেক রকম সাজে এসেছিল সেদিন৷ গান-নাচের পাশাপাশি ছিল খাবার ও পানীয়৷ অফিসের প্রায় সবার সাথে নেচেছিলেন ডয়চে ভেলের মহা পরিচালক পেটার লিমবুর্গ৷ ডয়চে ভেলের সাফল্য কামনা করে দিয়েছিলেন বক্তব্য৷
১৫ ফেব্রুয়ারি রোববার ছিল ছোটদের উৎসব৷ এদিনও সকাল সাড়ে ১১টায় কোলনে উপস্থিত হয়েছিলাম৷ সাজ যে কত বিচিত্র হতে পারে, তা এই কার্নিভালে না গেলে বুঝতাম না৷ পাকা মিষ্টি কুমড়ো সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট শিশুরা৷
ফল, পাখি, মাছ, বিড়াল, গরু, মোরগ, গরিলা – কী না সেজেছে তারা৷ কেউ বা সেজেছে পোকামাকড়৷ আবার কিছু ছেলে-মেয়ে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সদস্য সেজে ঘোরাফেরা করছিল৷ আমি অন্তত ৫০টি দলের প্যারেড দেখেছিলাম৷ কিন্তু হঠাৎ ঠাণ্ডা বেড়ে যাওয়ায় বিকেল চারটায় ফিরে এসেছিলাম বন-এ৷
এর পরদিন রোজেন 'মোনটাগ' অর্থাৎ 'গোলাপি সোমবার'৷ বন-এর রাস্তায় বের হতেই চোখে পড়ল নানা পোশাক পড়া মানুষ৷ কোলনে পৌঁছালাম সোয়া ১১টায়৷ কোলনে গিয়ে ট্রামে উঠেও চোখে পড়ল একই দৃশ্য৷ বিচিত্র সাজে সেজেছেন নারী-পুরুষ-শিশু সকলেই৷ কোলনের প্রধান স্টেশনে পৌঁছাতেই কানে এলো উদ্দাম ব্যান্ডের শব্দ৷
পুরো শহর ফাঁকা, যত ভিড় সব ক্যাথেড্রালের আশপাশে, অর্থাৎ কোলনের প্রধান স্টেশনের কাছে৷ সবার গন্তব্যই এক৷ সবাই ছুটছে সেদিকে৷ কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই৷ কী আনন্দ সবার চোখে মুখে!
রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানশালাগুলোতে ভিড় উপচে পড়ছে৷ শহরও যেন সেজেছে কার্নিভালের সাজে৷ আমি ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে এগুতে থাকি৷ একটি জায়গায় দাঁড়াই ভালোভাবে ছবি তোলার জন্য৷ চকলেটের তোয়াক্কা না করে ছবি তুলে যাচ্ছি৷
আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আসলেই বয়সের কোন সীমা নেই৷ সবাই যেন সেই ছোটবেলায় পৌঁছে গেছে৷ ৬০-৭০ বছর বয়সী নারী-পুরুষ যেন ৮-১০ বছরের শিশু৷ এত উচ্ছ্বাস, এত আনন্দ৷ কোথাও কোথাও দেখলাম স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের৷ তারা তাদের দল নিয়ে নিজেদের মতো করে মজা করছে৷
তবে কার্নিভাল যে গোটা জার্মানিতে পালন করা হয় – তা কিন্তু নয়৷ শুধু রাইন নদীর ধার ঘেঁষেই এই উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়৷ কোলন, বন ছাড়াও ড্যুসেলডর্ফ এবং মাইনৎস শহরেও কার্নিভালের পরশ লাগে৷
এছাড়া এত মানুষের ভিড়ে যেন কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা কিংবা দুর্ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল৷ ছিল সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ স্বেচ্ছাসেবী ও নিরাপত্তা দপ্তরের সদস্যরাও৷
তবে কেবল যে জার্মানির মানুষই উৎসবে যোগ দিয়েছেন, তা কিন্তু নয়৷ সেখানে গিয়ে শুনতে পেলাম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন কেউ এসেছেন ইটালি থেকে, কেউ বা লুক্সেমবুর্গ থেকে, কেউ বা ফ্রান্স থেকে৷
আসলে কার্নিভাল অনেকটা আমাদের বর্ষবরণ উৎসবের মত৷ যেখানে মানুষ ভুলে যায় সমস্ত ভেদাভেদ৷
শোভাযাত্রা শেষ হওয়ার কথা বিকেল পাঁচটায়৷ কিন্তু দুইটার সময় ভিড় ঠেলে ট্রেন স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকি৷ স্টেশনে যাওয়ার একটি পথই আমার চেনা৷ কিন্তু সব দিকে কেবল মানুষের মাথা চোখে পড়ছিল৷ মূল রাস্তার মধ্যেখানে ব্যারিকেড দেওয়া এবং সেখান দিয়ে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না৷
অবশেষে প্রায় এক ঘণ্টা পুরো পথ ঘুরে ঘুরে শেষে ৫ নম্বর ট্রাম নিয়ে কোলন স্টেশনে পৌঁছে দেখি, যে ট্রেনে যাব সেটি এই মাত্র চলে গেল৷ পরের ট্রেন ৩টা ২৯ মিনিটে....কি আর করা? তাই সেই ট্রেন ধরেই অবশেষে সোয়া চারটায় বন স্টেশনে পৌঁছালাম প্রচণ্ড ক্লান্তি আর বর্ণিল কিছু স্মৃতি নিয়ে৷
(চলবে)...
লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়চে ভেলে, বাংলা বিভাগ
ইমেইল amrita.modak81@gmail.com
অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ-বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের পাঠিয়ে দিন। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন। probash@bdnews24.com |