বুদোর রূপে বুঁদ হয়ে যাওয়ার গল্প

বহুদিন থেকেই বুদো যাব যাব করছি, যাওয়া হয়ে উঠছে না। হুট করেই পরিকল্পনা করলাম, বুদো যাবোই। তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে রওনা হলাম পাঁচজনের ছোট দল নিয়ে।

আসমা সিদ্দিকা, সুইডেন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2017, 10:33 AM
Updated : 24 Feb 2017, 10:50 AM

নরওয়ের একটা ছোট্ট আর সুন্দর শহর বুদো। সমুদ্রের কিনারের শহরটার গল্প শুনেছি খুব। দলে আছে আমার ভাই নাহিদ। এমনিতে ঘরের ভেতর তার মত অলস কেউ নেই। তবে বাইরে গেলে সে খুব মজার। তাই ভ্রমণটা মজার হবে বলেই ধরে নিয়েছিলাম।

সত্যি বলতে কোথাও ঘুরতে গেলে আমরা তিন ভাই-বোনই মজা করি খুব। বড় ভাইয়াও মজার। আর আছে আমার দেড় বছরের মেয়ে আদ্রিয়ানা। ওর বাবা আর তার ইথিউপিয়ান এক বন্ধু ওমর। এরা দু’জনেই খুব ভালো ড্রাইভ করে। পাহাড়ি ভয়ানক রাস্তা পাড়ি দিয়ে অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে। সুইডেনে আমরা যে শহরে থাকি, সেখান থেকে বুদো অবধি গাড়িতে যেতে আট-নয় ঘণ্টা লাগবে। 

রাতেই রওনা দিলাম। সময়টা তখন আগস্টের শুরুর দিকে। যেহেতু এখানে জুলাই আর আগস্ট মাসে রাতে আঁধার হয় না, তাই রাতভর দিনের মতোই আলো থাকবে। সেটা অবশ্য আমাদের চলার পথে সাহায্য করবে।

ছুটলাম নতুন শহর দেখার আনন্দে। মাঠ, ঘাট, পাহাড়, নদী ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলছে। একটা সময় এলো রাস্তার দুই ধারে শুধু পাহাড় আর নদী। অদ্ভুত মনোরম সেই দৃশ্য। পাহাড়ি ঝরনা বেয়ে পানি নামছে। কিছু কিছু ঝরনার পানি বরফ হয়ে জমে আছে। পাহাড়ের মাঝে মাঝে কিছু ঘরও দেখা যাচ্ছে। ডানে দেখব নাকি বামে দেখব বুঝতে পারছিলাম না। কিছু কিছু জায়গায় গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি। ছবি তুলি। সে কী আনন্দ! দুই ভাই-বোন ছোট্টবেলার মত ছোটাছুটি করছি।

একসময় গাড়ি থেকে নামতে নামতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। কারণ সামনে যতই দেখি, দেখি আরও সুন্দর। পাহাড় আর সমুদ্র সামনে থেকে দেখলে মনটা কেমন হয়ে যায়। জগৎ-সংসারের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, ভাল-খারাপ- কিছুই তখন মাথায় আসে না। শুধু মনে হয়, জীবনটা কত ছোট!

পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা শুভ্র বরফ, পাহাড়ের রূপ আর বিশালতা দেখতে দেখতে আমার মুগ্ধ চোখে পানি চলে আসলো। সত্যি অদ্ভুত মায়াময় সেই রূপ! পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা বরফগুলো পাহাড়ের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে যেন। জানালায় তাকিয়ে ফেলে আসা জীবনের নানা স্মৃতি মনে ভেসে আসছিল, ছেলেবেলার কত কথা মনে পড়ছিল!

এক সময় আমরা চলে এলাম নরওয়ের সীমান্তে। এখানে লোকজন নেই,পাহারা নেই- শুধু দুই দেশের রাস্তা দুই রঙ করা। আমরা নেমে পড়লাম। সাথে থাকা খাবার আর চা-কফি খেলাম। কিছুটা সময় পাহাড়ের গহীনে হাঁটাহাঁটি করলাম। ঝরনাগুলোর খুব কাছে গেলাম। জায়গাটা এতো উঁচুতে যে ঠাণ্ডায় সবাই জমে যাচ্ছিলাম।

এরপরে এলো সেই আঁকাবাঁকা ভয়ানক পাহাড়ি রাস্তা। নিচে গভীর খাঁদ, সরু আর পিচ্ছিল রাস্তা। আমরা তখন মেঘের উপরে। কী অদ্ভুত সেই দৃশ্য! চারপাশে মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে, প্রতিটা মুহূর্তে মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে। তার ওপর এত সুন্দর দৃশ্য! ভয়ানক সৌন্দর্য বুঝি একেই বলে! কয়েকবার পড়ি পড়ি করে সেই রাস্তা অতিক্রম করলাম।

তারপর পাহাড়ের ছোট-বড় সুড়ঙ্গ পেরিয়ে অবশেষে বুদোর সীমানায়। শুরুতেই সাগর, সাগরের পাশ ঘেষে বুদো ঢোকার পথ। কখন যে নয় ঘণ্টা শেষ হয়ে গেল, বুঝলাম না।

আগে থেকে বুকিং করা হোটেলে উঠলাম, হোটেল রুম থেকেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। ফ্রেশ হলাম, খেলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম। ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। সত্যিকার অর্থেই এত সুন্দর একটা শহর, যেন দেখার শেষ নেই। খুব অল্প সময়ের মাঝে আমরা অনেক জায়গা দেখে নিলাম। 

স্পিডবোটে করে সমুদ্রে ঘুরলাম। ছোট ছোট দ্বীপে গেলাম। ছোট-বড় অনেক দ্বীপ আছে। কিছু কিছু স্থানীয় লোক ছাড়া বাকি সবাই গরমের ছুটিতে এসেছে। কেউ মাছ ধরছে, কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ গ্রিল করায় ব্যস্ত। আবার কেউ সানবার্ন করছে। যে যার মত উপভোগ করছে।

কয়েকজন আমাদের কাছে এসে গল্প করলো। আমরা ক্লান্ত হলেও আবার এসে শহরটা দেখতে লাগলাম। সত্যি খুব অন্যরকম একটা শহর। ছোট আর ছিমছাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আধুনিকতার সংমিশ্রণে অপরূপ বুদো।

শত বছরের পুরনো দালানগুলো আপন সৌন্দর্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আদর্শ জায়গা বুদো। পর্যটকদের ভীড়ে হাঁটা দায়। সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে হোটেল, রেস্তোরাঁ, ছোট-বড় নৌকা- এক কথায় জমজমাট।

সারা রাত হইচই! নরওয়ে,সুইডেনের মত নিরব দেশে এমন শোরগোল অবাক করার কথাই। শহরের মানুষগুলোর মধ্যে সুখী সুখী ভাব আর আন্তরিকতা চোখে পড়ার মত। এরা খুব হাসিখুশি। সুইডিশ আর ফিনল্যান্ডের লোকদের সাথে অনেক মিল থাকলেও এরা তাদের তুলনায় অনেক আন্তরিক। নরওয়ে আর সুইডেনের ভাষাতেও অনেক মিল আছে।

যাই হোক,আমরা অনেক ঘুরলাম, খেলাম, শপিং করলাম। পুরনো পরিচিত কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। আর নতুন অনেকের সাথে পরিচয় হল। ইথিউপিয়ান এক পরিবারের বাসায় ডিনারের আমন্ত্রণে গেলাম। চমৎকার আতিথেয়তা আমাদের ঘরের আমেজ দিল। ওরা আমাদের অনেক সময় দিল। ঘুরিয়ে দেখাল।

ছোট এই বুদোতে খাবারের দাম নাগালের বাইরে। তিনটা দিন কীভাবে যেন কেটে গেল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি যাত্রা ধরলাম। আবার সেই পাহাড়ি পথ। আমরা জানতাম না সামনে কি অপেক্ষা করছিল।

সমুদ্রকিনার পার হয়ে, পাহাড়ি সুড়ঙ্গগুলো পার হয়ে যখন মেঘের উপর সেই ভয়ানক রাস্তায় পৌছুলাম,তখন দেখি সেখানে বিশাল জ্যাম আর ভীড়। ওই সরু রাস্তায় বেকায়দায় সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। আমরাও আটকা পড়ে রইলাম। দু’টো গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ায় এই অবস্থা। তিনটা ছেলেমেয়ে মারা গেছে। এতই সরু রাস্তা, পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সকেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বেশ ভয় লাগছিল। নিচে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু অনুমান করা যাচ্ছিল কত উঁচুতে আমরা।

চারপাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বুদো ভ্রমণে এই দৃশ্যটা স্মরণীয়। এখান থেকে পড়লে কী হবে ভাবতে চাচ্ছিলাম না, তবু ভাবনাটা মাথায় ঘুরছিল। চার ঘণ্টার মত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সাথে খাবারও তেমন ছিল না। যন্ত্রণাময় অপেক্ষা। তারপর ওই রাস্তাটা পার হওয়ার পর সুন্দরভাবে বাকি পথ পার হলাম।

মাঝে মাঝে হরিণ এসে পথ আটকে দেয়। হেলেদুলে ওনারা রাস্তা পার হয়। মন চাইলে রাস্তায় বসে থাকে। আমরাও বসে থাকি কখন ওনাদের মর্জি হয়, আমাদের যেতে দেয়।

অবশেষে ভালভাবেই ঘরে ফিরলাম। কিছু কিছু জায়গা দেখা হয়,যেখানে জীবনে দু’বার যাওয়া হয় না, তেমনি কিছু মানুষের সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হয়না। তবু মনের কোণে স্মৃতিটুকু থেকে যায়।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ই-মেইল: siddika.asma@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!