অমর একুশ: মায়ের কাছে শোনা প্রথম গল্প

অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাস জীবনের শুরুতে কিছুদিন সিডনিতে ছিলাম। সেখানে লাকেম্বা নামে এলাকায় বাংলায় লেখা একটা সাইনবোর্ড হঠাৎ চোখে পড়লো।

নাদিরা সুলতানা নদী, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2017, 11:52 AM
Updated : 21 Feb 2017, 11:52 AM

আমি সাইনবোর্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে করছিলো বাংলা অক্ষরগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। আহা! বাংলাদেশ, আমাদের রক্তমাখা বর্ণমালা। চোখে মেলে তাকিয়েই ছিলাম অনেকক্ষণ। দেশের কথা মনে আসতেই চোখটা ছলছল করে উঠলো।

সে এক অন্যরকম অনুভূতি, বুকের মাঝে বাংলাদেশের সুখ জাগানিয়া স্মৃতি। আমার চার বছরের ছেলে নভো ঘরের বাইরে গেলে বাংলায় কাউকে কথা বলতে শুনলেই চেঁচিয়ে উঠে, ‘আম্মু আম্মু বাংলা!’। ওর এই কথা দিয়েই অস্ট্রেলিয়ায় কতজনের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলাম ২০০৯-এ অ্যাডিলেইডে। একদিন সেখানকার টিএএফই সিটি ক্যাম্পাসে গিয়েছি ইংরেজি কোর্স সম্পর্কে জানতে। তথ্যকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বড় একটা বোর্ডে চোখ বুলাচ্ছিলাম, ভর্তি সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তি খুঁজছিলাম। তারই শুরুতে দেখি, ‘ওয়েলকাম’ শব্দটা অনেকগুলো ভাষায় লেখা রয়েছে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে বাংলা খুঁজতে লাগলাম।

কিন্তু না, বাংলা পেলাম না। একটু হতাশই হলাম। পরে অফিসে কথা বলে জানলাম তারা বাংলা যোগ করতেই পারেন। তবে বিষয়টা নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানটিতে কতো সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষি ছাত্র-ছাত্রী আছেন তার উপর। সেখানে বসবাসরত সেই ভাষার মানুষ যারা আছেন, তাদের চাওয়াটাই হলো আসল।

এইরকম বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার সময়-সুযোগ এবং মানসিকতার লোক হাতেগোনা। আর বিদেশ জীবন একটু বেশিই ব্যস্ত জীবন। আমি একা কিছুই করতে পারলাম না। যতটুকু পারলাম তা নিজের কাজের জায়গায়। বাংলা বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষে আমার সব মাল্টি-কালচারাল সহকর্মীদের ‘শুভ নববর্ষ’ বলা শিখিয়ে দিয়েছি। তারা আগ্রহ নিয়ে শিখেছেন। এক ১৪ এপ্রিল অফিস গিয়ে দেখি অস্ট্রেলিয়ান ক্যাম্পাস ম্যানেজার আমার ডেস্কে ইংরেজিতে লিখেছেন ‘শুভ নববর্ষ’। এটা এক টুকরো ‘বাংলা’ ভালো লাগা।

আমি কাজ করছি বাংলা কমিউনিটি রেডিওতে। এর আগে প্রায় তিন বছর কাজ করেছি রেডিও বাংলা অ্যাডিলেইডে। তারপর এখন রেডিও বাংলা মেলবোর্নে। সপ্তাহে একটি দিন এখানকার ইথারে ইথারে একঘণ্টা বাংলায় কথা বলি। মন খুলে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে বাংলা বলতে সুখের নেই কোন সীমানা।

মায়ের ভাষা শুধু একটি ভাষা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশিকিছু। আমাদের অস্তিত্ব, নিজস্বতা, স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদা বোধের জায়গা হলো মায়ের ভাষা। তাই বারবার বলতে ইচ্ছে করে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। সেই বায়ান্নতে যখন আমাদের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো, আমাদের পূর্বপুরুষেরা হুঙ্কার দিয়ে সেটি প্রতিহত করেছিলেন। কারণ, সেটি ছিল আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষার প্রতি এই টানটা বিদেশের মাটিতেও ধরে রাখতে পারি, সেটিও অনেকভাবে দেশকেই তুলে ধরা বা তার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করা।

আজ পুরো বিশ্বে চীনের প্রভাব তৈরি হতে দেখছি, বিভিন্ন দেশে  আজ ওদের ম্যান্ডারিন ভাষা শেখার স্কুল তৈরি হচ্ছে। দুবাইতে শুধু ভারতীয়দের আধিপত্যের জন্য হিন্দি ভাষা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে, পাচ্ছে কানাডাতেও।

আমি আজ প্রবাসী। আমরা যারা বাঙালি, আমাদের বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা এখানে বড় হচ্ছে। তাদের জন্য এখানে ছোট আঙ্গিকে হলেও অনেক বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। তবে এখানে জন্ম হয়েছে বা বাংলাদেশ থেকে একদম ছোট বয়সে চলে এসেছে এমন বাচ্চাদের অনেক মা-বাবাকেই দেখেছি ওদের ইংরেজি শেখানোর জন্য খুব তোড়জোড় করেন। আমার মনে হয় না এটার দরকার আছে।

প্রবাসী নতুন প্রজন্ম এমনিতেই ইংরেজি শিখবে। বরং ওদের সঙ্গে বাসায় থাকা পুরো সময়টুকু বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করা উচিৎ। সম্ভব হলে বাংলা টিভি-প্রোগ্রামগুলো দেখানো যেতে পারে। কারণ ওরা যখন বাংলাদেশে বেড়াতে যাবে, ভাষাগত যোগাযোগটা হবে সাবলীল। এতে ওর মাঝে পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় হবে।

ভাষার মাসে তাই আমার একটিই প্রত্যাশা- মানুষের সেই চেতনা বোধ জাগ্রত থাকুক। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রতিটি ব্যাক্তি ও জাতিগোষ্ঠির মাতৃভাষার অধিকার নিশ্চিত হোক। আমার সন্তানের মতো মারমা অথবা তুতশী শিশুটিও নিশ্চিন্তে কথা বলুক তার মায়ের ভাষায়- নিরাপদ থাকুক তার প্রতিটি বর্ণমালা।

পৃথিবীর সব শিশুরা তাদের মায়ের বুকে শুয়ে নিশ্চিন্তে শুনুক তার মায়ের ভাষায় বলা প্রথম গল্প।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি, সাবেক ছাত্রনেতা

ই-মেইল: sultana.nadera@gmail.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!