সেখানে গেলেই দেখা মেলে এই তিন বোনের। ইকো পয়েন্টে গেলে দেখা যায় তিনটি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। যাদের উচ্চতা বড় থেকে ছোট ক্রমান্বয়ে ৯২২, ৯১৮ ও ৯০৬ মিটার। এদের একসাথে ‘থ্রি সিস্টারস’ বলা হয়।
এই তিন বোন বা থ্রি সিস্টারস নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি মিথ হচ্ছে কাতুম্বা গোষ্ঠীর তিন বোন মেহ্নি, মিলাহ ও গান্নিডো বাস করতো জামিসন উপত্যকায়। তারা প্রেমে পড়ে আরেক গোষ্ঠীর তিন ভাইয়ের সাথে।
কিন্তু উপজাতীয় আইনে তাদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ ছিল। সেই তিন ভাই এই নিয়ম মানতে রাজি নয়, যেভাবেই হোক তিন বোনকে তারা বিয়ে করবে। অবশেষে তারা যুদ্ধ বাধালো দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। যুদ্ধের মধ্যে তিন বোনের নিশ্চিত বিপদ দেখে কাতুম্বা গোষ্ঠীর এক জাদুকর মন্ত্রবলে তাদের যাদু করে তিনটি পাথর বানিয়ে রাখেন।
সিডনি আসার পর অনেকবার যাওয়া হয়েছে ব্লু মাউন্টেইন। কেউ দেশের বাইরে থেকে বা অন্য স্টেট থেকে আসলেই বেড়াতে যাওয়া হয় সেখানে। অনেকবার গেলেও শীতের সময় যাওয়া হয়নি কখনও।
এইবার শীতে মা আসলেন দেশ থেকে। এখানে শীতের সময় দিন খুব ছোট আর পাঁচটার আগেই অন্ধকার হয়ে যায়। অনেক শীত পড়ে সিডনিতে। বাইরে তেমন ঘুরতে যাওয়াও যায় না ঠাণ্ডার জন্য। শীতের সময় ব্লু মাউন্টেইন স্নো পড়ে, আর তাপমাত্রাও অনেক নেমে যায়। মায়ের আবার স্নো পড়া দেখার খুব ইচ্ছা। আমি নিজেও কখনো দেখেনি।
তবে নিউ সাউথ ওয়েলসে স্নোয়ি মাউন্টেইন বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে দারুণ স্নো দেখা যায়, কিন্তু দুই দিনের প্ল্যান করে যেতে হবে। অনেক দূরে তাই সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা এবার নাই। তাই আমরা ভাবছিলাম ব্লু মাউন্টেইন কাছে আছে, যদি এখানে দেখা যায় খারাপ কি!
আবহাওয়ার আপডেট দেখলাম। এখানে আবহাওয়া তেমন পরিবর্তন হয় না। স্নো পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর দিনটি ছিল রোববার। তাই আর কোনদিকে না তাকিয়ে ওইদিন বেরিয়ে পড়লাম, মা আর মেয়ে মিলে সকাল সকাল। যা আছে কপালে।
আমরাই শুধু ঘুরতে বের হয়েছি। মা শুধু ভয় পাচ্ছেন আর বলছেন- না আসলেই হত। এতদিনে উনার অবশ্য সিডনি সর্ম্পকে ধারণা পাল্টে গেছে। প্রথম আসার পর আমার সঙ্গে বের হতে চাইতেন না, উনার মতে আমরা দুজন মেয়ে মানুষ একা বের হওয়া মানে বিপদ। তারপর ট্রেনের কথা বললে বলতেন- ভিড় হবে, এখানে কেন রিকশা নাই ইত্যাদি।
কিন্তু যখন দেখলেন এখানকার মানুষ লাইন ধরে ট্রেনে উঠে, রাস্তা পার হতে নিয়ম মানে। ভিড় কিংবা সিট না থাকলে উনাকে উঠে নিজের সিট দিচ্ছে। শুধু উনাকে না, যে কোন বয়স্ক মানুষ আর বাচ্চাসহ মায়ের জন্য সিট রাখাই আছে। এই সিটগুলোতে শুধু এদের প্রায়োরিটি। মা অবাক। এভাবে বাংলাদেশে তো কল্পনা করতে পারি না আমরা।
সাড়ে এগারটার দিকে পৌঁছে গেলাম কাটুম্বা স্টেশন। সেখান থেকে ব্লু মান্টেইন যাওয়ার বাস আছে। আমরা বাসে চড়ে পৌঁছে গেলাম মেইন স্পট ইকো পয়েন্ট যেখান থেকে থ্রি সিস্টারস দেখা যায়। যাওয়ার পথে পড়ে স্ক্যানিক ওয়াল্ড। এখানে আরও দর্শনীয় স্থান আছে- কাটুম্বা ফলস, ওয়েন্ট ওয়ার্থ ফলস, বোটানিক গার্ডেন ও ট্র্যাকিং করার জন্য আছে পাহাড়।
ইকো পয়েন্ট থেকে হেঁটে থ্রি সিস্টারস এর ভিতরে যাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা আর অনেক লম্বা সিঁড়ি। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবেন কিনা। দেখি উনিও রাজি। সেই খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে আমরা নিচে নামলাম আর উপরে উঠার সময় দেখলাম উনি আর পারছেন না। একটা ছেলে মাকে তুলতে সাহায্য করল। আমরা হাঁপিয়ে গেলাম।
দুপুর হয়ে গেল। লাঞ্চ সাথে করে নিয়ে গেয়েছিলাম। তাই খাওয়া হল। থ্রি সিস্ট্রারস ট্র্যাকিং আর লাঞ্চ শেষ করে আমরা ফিরে এলাম ইকো পয়েন্টে। সেখানে কিছু শপ আছে সোভেনিওয়র, কার্ড, খেলনা, চাবি রিং এসব কিনতে পাওয়া যায়। আমরাও কিছু কিনলাম। তিনটা বাজে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, কিন্তু স্নোয়ের নামগন্ধ নেই। কি আর করা স্নো ফলিং না দেখেই ফিরতে হবে।
এইদিকে একটু পর অন্ধকার হয়ে আসবে। আমাদের ফিরতে হবে। ফেরার পথে গেলাম স্ক্যনিক ওয়ার্ল্ড। সেখানে রোপ ট্রেনে করে উপরে ঘুরলাম। আমরা অনেক উপরে উঠছি, এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
স্নো ফলিং আর দেখা হল না। কিন্তু আমার সঙ্গে আমার মা ব্লু মাউন্টেইন ঘুরে অনেক আনন্দ পেয়েছেন, সেটাই হল আমার অনেক বড় পাওয়া। আর সেই তিন বোনকে বিদায় জানালাম।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ইমেইল: susmitajamy@yahoo.com
লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |