ভালোবাসার গল্প: গায়ক ভিক্ষুক ও তার কুকুর

২০০০ সালের কথা। আমি তখন সিডনিতে একটা বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করি। প্রতিদিন সকালে ম্যারিকভিল থেকে ট্রেনে করে সেন্ট্রাল স্টেশনে নেমে পার্কের সামনে থেকে মাড়বরাগামী বাসে উঠি।

নাইম আবদুল্লাহ, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2017, 09:52 AM
Updated : 12 Feb 2017, 09:53 AM

আবার বিকেলে ফিরে আসি। কয়েকদিন ধরে ফিরবার পথে দেখি একটি অল্পবয়সী যুবক সেন্ট্রাল পার্কের সামনের রাস্তায় গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। তার সামনে রাখা হ্যাটে পথচারীরা কয়েন দিচ্ছে। পাশেই বেঁধে রাখা একটি বড় নাদুস-নুদুস কুকুর। ছেলেটির চেহারায় বেশ আভিজাত্যের ছাপ।

একদিন আসার সময় কি মনে করে আমি ছেলেটির পাশে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ছেলেটি তার গান শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বিনম্র ভঙ্গিতে বলল, ‘হ্যালো’। আমি উত্তরে বলাম, ‘হাই’। আমি বেঞ্চি থেকে উঠে ছেলেটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে তখন তার হ্যাটটি হাতে নিয়ে কয়েন গোনায় ব্যস্ত। পাশে বসা তার কুকুরটিও উৎসুক চোখে মনিবকে অনুসরণ করছে।

আমি তার সাথে সহজ হওয়ার জন্য বললাম, আজকে তোমার দিন কেমন গেলো? সে হাসি হাসি মুখে বলল, আজ আমার লাকি ডে। অনেক গোল্ড কয়েন পেয়েছি। সাথে সাথে তার কুকুরটিও লেজ নাড়িয়ে মনিবের কথায় সায় দিলো। তখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। সে তার কয়েন সমেত হ্যাট আর গিটারটি বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে কুকুরের বাঁধা শেকল খুলে হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।

আমি বললাম, এসো আজ আমরা একসঙ্গে ডিনার করি? ছেলেটি এক মুহূর্তের জন্য আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। কিন্তু পরক্ষণেই ঘাড় নাড়িয়ে আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। আমি রাস্তার ওপারের একটি ফাস্ট ফুডের দোকান দেখিয়ে বললাম, চলো আমরা ঐ দোকানটাতে গিয়ে বসি। ছেলেটি বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ওখানে টমকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ঢুকতে দিবে না।

আমার ততক্ষণে হুশ হল। আর জানলাম তার সাথের কুকুরটির নাম টম। তুমি বরং কষ্ট করে আমার জন্য একটা কোয়াটার প্যাক আর সফট ড্রিঙ্ক নিয়ে এসো। আমি ভদ্রতা করে বললাম, টমের জন্য কি আনবো? ও কি চিকেন ড্রামস্টিক খেতে পারবে? না, ওকে বাইরের খাবার অ্যালাউ করি না। কারণ আমি অ্যাফোর্ট করতে পারবো না। সে তার কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগটা দেখিয়ে বলল, ওর খাবার এখানে আছে। তুমি ব্যস্ত হইও না।

আমি দোকান থেকে প্যাকেটে করে খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখলাম টম ও তার মনিব সেন্ট্রাল পার্কের ভেতরের একটা বেঞ্চিতে জায়গা করে নিয়েছে। তখন বসন্তকাল। পার্কে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। পাশের রাস্তায় পথচারীদের ব্যস্ততা ততক্ষণে অনেক কমে গেছে।

টম আমাকে ফিরতে দেখে লেজ নাড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। ছেলেটি আড়ষ্টভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দুঃখিত, আমি তোমাকে এখন পর্যন্ত আমার নামটাই বলিনি। আমার নাম জিম। জিম এন্ডারসন। আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের নাম বললাম। নাইস টু মিট ইউ। জিম তার ব্যাগ থেকে টমের জন্য খাবার বের করে তাকে দিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, টমের জন্য খাবার কিনতে তোমার কষ্ট হয়না? সে বলল, আমি গান গেয়ে যে ডলার পাই তার প্রায় সবটাই টমের খাবার আর তার ভেট (পশু চিকিৎসক) এর জন্য খরচ হয়ে যায়। আমি নিজের জন্য সরকার থেকে বেকার ভাতা পাই।

তারপর কথায় কথায় বলল, আমি ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ছেলে। বাবা মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর আমি একা হয়ে যাই। ওরা দুজনেই নাইট ক্লাবে গান করতো। তাদের কাছ থেকেই আমার গান আর গিটারের হাতেখড়ি। তাহলে তুমিও তো নাইট ক্লাবে গাইতে পারো? তা পারি। কিন্তু আমার নাইট ক্লাবে মাতালদের সামনে গাইতে ইচ্ছে করে না।

আমি মনে করি গান কিংবা ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো একটা শিল্প। এটার কদর কিংবা দরদ মাতালরা কি করে বুঝবে? তাহলে তুমিও ড্রিঙ্ক করো না? ড্রিঙ্ক করবো না কেন? কিন্তু মাতাল হয়ে শিল্পচর্চাকে আমি ঘৃণা করি। তাইতো আমার কোন কনসার্টে গান করার খুব ইচ্ছা। সেজন্যই ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া থেকে সিডনি এসেছি, যদি কোন অফার পাই। তখন আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, টমের পেছনে যে বাড়তি ডলার খরচ হয় তা তোমাকে রাস্তায় রাস্তায় গান করে রোজগার করতে হচ্ছে। এই সময়টায় তুমি গানের রিহার্সসেল করে বা কোন কনসার্টে গানের অফার পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজখবর করতে পারতে।

জিম মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলল, ঠিক তা নয়। টম আমার একজন ভালো সঙ্গী। তাই তার জন্য গান গেয়ে ডলার আয় করতে আমার কোন আপত্তি নাই। আচ্ছা টমকে কেনার গল্পটা তোমাকে বলি, শুনবে? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই বলল, মাস ছয়েক আগে গিটার হাতে একটি পেট-শপের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দোকানদার ডেকে গান শোনাতে বলল। আমর গান শুনে দোকানের অন্যান্য বাচ্চা কুকুরছানাগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।

শুধু বাচ্চা টম সারাটাক্ষণ নিরবে গান শুনলো। গান শেষে আমি টমকে কিনতে চাইলাম। কিন্তু আমার কাছে অতো ডলার না থাকায় লে-বাই করে আসলাম। আসলে সেদিন থেকেই আমি বাকি ডলার সংগ্রহের জন্য রাস্তায় রাস্তায় গিটার বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করলাম। দুই সপ্তাহের মাথায় আমি সেই পেট-শপ থেকে টমকে কিনে আনলাম।

আশ্চর্য বিষয় কি জানো? আমি যতক্ষণ গান করি সে ততক্ষণ একজন সমঝদার শ্রোতার মতো এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি নিশ্চয়ই একদিন বড় গায়ক হয়ে কনসার্টে গাইবো। সেদিন টমকে স্টেজে আমার পাশে বসিয়ে রাখবো। সে পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে আর আমি একের পর এক গানে সুরের ঝড় তুলবো। অনুষ্ঠান শেষে পাওয়া ডলারগুলো সমান দু’ভাগে ভাগ করে টমের ভাগটা ওকে বুঝিয়ে দেব।

পাশের স্ট্রিট লাইটের আলো পড়ে জিমের ভেজা চোখ চিকচিক করে উঠলো। আমি বিদায় নিয়ে চলে আসতে চাইলে সে একটি গান শোনানোর অনুরোধ করলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পাশে বসা টম ঠিক যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে গান শুনছে।

পরের এক সপ্তাহ আমাকে অন্য এলাকার একটি ব্যাংকে কাজের জন্য পাঠানো হল। ফিরে এসে আমি জিম আর টমকে আর খুঁজে পেলাম না। এখনও মাঝে মাঝে টেলিভিশনে কিংবা ইউটিউবে যখন কোন ইংরেজি গানের কনসার্ট দেখি তখন অবচেতন মনে জিমকে খুঁজি।

মনে মনে ভাবি, হয়তো এতদিনে সে তার লম্বা চুল দাঁড়ি কেটে ফেললে তাকে আর চিনতে পারব না। কিন্তু স্টেজে তার পাশে বসে থাকা টমকে দেখলে আমি ঠিকই তাদের চিনতে পারবো।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!