জার্মানির হাসি, বেঁচে থাক সর্দিকাশি

এ পর্যন্ত আমার ইউরোপের দিনপঞ্জি পড়ে আপনাদের হয়ত মনে হতে পারে জার্মানদের সম্পর্কে সবকিছুই আমার ভীষণ ভালো লাগে৷ এদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ বা নেতিবাচক ধারণা নেই৷ বিষয়টা কিন্তু মোটেও তেমন নয়।

অমৃতা পারভেজ, জার্মানির বন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2017, 10:31 AM
Updated : 10 Feb 2017, 10:40 AM

জার্মানদের গোমড়া মুখ দেখলে তাদের সম্পর্কে আমার সব ইতিবাচক ধারণা ভুলে যেতে ইচ্ছে করে৷ ব্যাপারটা কেমন বলি৷ জার্মানি থেকে বাংলাদেশে বিমান থেকে নেমে যখন ইমিগ্রেশনে গেছি, তখন ইমিগ্রেশন অফিসার হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতদিনের জন্য এলেন?

এই যে হাসি- এটা জার্মানিতে বছরে দুইবার দেখা যায়। এক- কার্নিভালের সময়, দুই- যখন তারা মাতাল হয়৷ কিন্তু স্বাভাবিক হাসি হাসতে তাদের যেন ভীষণ কষ্ট৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভূত যেন তাদের ঘাড়ে আজও চেপে বসে আছে৷

বিশেষ করে ট্রাম বা ট্রেনে অন্য কোন দেশি মানুষ যদি গল্প বা হাসিঠাট্টা করে তারা এমনভাবে তাকায়, যেন হাসি একটা অপরাধ৷ সত্যি তাদের দৃষ্টি দেখে লজ্জা লেগে যায়, হাসি দিয়ে কোন ভুল করলাম কিনা!

এতো গেলো হাসির কথা৷ এবার বলি হাঁচি-কাশির কথা৷ এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রেমের গল্প ‘বেঁচে থাক সর্দিকাশি’র কথা মনে পড়ে গেলো৷ শীতকালে জার্মানিতে ট্রাম-বাস-ট্রেনে কিংবা রাস্তাঘাটে চলাচল করলে আপনার কাছে সত্যিই মনে হবে সর্দি কাশিরা বেঁচে আছে এখানে। শুধু কি বেঁচে আছে, রীতিমত চলাফেরা করছে তারা!

কেননা আমাদের দেশে সবার সামনে গলায় শব্দ করে কফ ফেলা বা নাক ঝাড়া অভদ্রতা মানা হয়৷ কিন্তু এখানে এটা ভীষণ সাধারণ৷ সবচেয়ে বিরক্ত লাগে যখন ক্যান্টিনে খেতে বসেছি, আর পাশের লোকটা রুমাল বের করে শব্দ করে নাক ঝাড়লো। আমার খাওয়া দাওয়া উঠলো মাথায়৷ প্রথমবার যখন ট্রামে একজন জার্মানকে দেখেছিলাম রুমালে নাক ঝেড়ে সেটা আবার পকেটে রেখে দিতে, তারপর থেকে কোন জার্মানের সঙ্গে হাত মেলাতে আমার একটু সংকোচ হয়৷

এবার আসি ভাষার ব্যাপারে। ভাষা নিয়ে আমরা বাংলাদেশিরা যতটা গর্ব করি, ততটা প্রয়োগ হয়তো করি না৷ কিন্তু জার্মানরা এদিক দিয়ে ভীষণ একরোখা৷ এক জায়গায় দীর্ঘদিন থাকলে সেখানকার ভাষা শিখে নেওয়াটা জরুরি, এটা আমিও মানি। কিন্তু প্রথমবার জার্মানি এসে ইমিগ্রেশন অফিসার যদি আপনাকে জার্মান ভাষায় প্রশ্ন করেন, সেটা কি মেনে নেওয়া যায়!

এই যে তাদের ভাষাটা জানতেই হবে এবং ভাষা নিয়ে এই উন্নাসিকতা, এটা কিছু ক্ষেত্রে অনেককেই বিব্রত করে৷ যে মানুষটা জার্মানিতে প্রথমবারের মতো এসেছেন সে গ্রোসারি-শপে গিয়ে দোকানদারকে কোনও প্রশ্ন করলে তার দিকে বাঁকা চোখে তাকানো মানা যায় না৷ কেননা প্রতিটা পণ্য জার্মান ভাষায় লেখা৷ কোনটা লবণ, কোনটা চিনি, কোনটা আটা, আপনি বুঝবেন কি করে! আবার লবণ আর চিনিরও রয়েছে প্রকারভেদ৷

এবার আসি টয়লেটে পানি প্রসঙ্গে৷ ইউরোপের অনেক দেশের মতো জার্মানিতেও টয়লেটে হ্যান্ড শাওয়ার নেই৷ প্রস্রাব বা পায়খানার পর আপনাকে টিস্যু ব্যবহার করতে হবে৷ কলকাতার জনপ্রিয় এক বাঙালি শিল্পী ইউরোপ ট্যুর শেষ করে দেশে ফিরে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিলেন, দেশে এসে সবচেয়ে শান্তি পেয়েছেন টয়লেট করে। কেননা শান্তিমতো পানি খরচ করতে পেরেছেন৷

প্রাগসহ কিছু পুরনো শহরে দু’ধরনের কমোড থাকে। একটির পেছনে একটা নলের মতো থাকে, যা আপনার পশ্চাৎদেশ প্রক্ষালন করবে৷ আর অন্যটি সেই নল ছাড়া৷  অর্থাৎ যারা পানি দিয়ে ধোয়ার কাজটি সারতে পছন্দ করেন, তারা নলসহ কমোডটি ব্যবহার করতে পারেন৷ আর ইউরোপে বাড়ির টয়লেটগুলো খুব একটা বড় হয় না৷

কিন্তু আমাদের দেশে আমরা টয়লেট এমনভাবে তৈরি করি যেন সেটা আয়েশের জায়গা। জার্মানিতে সেটা এতই ছোট যে কোনরকম কাজ সেরে বেরোতে পারলেই যেন বাঁচা যায়৷ আমি মাঝে মাঝে ভাবি জার্মানদের কাছে গাছ বড় নাকি পানি বাঁচানো? কেননা টিস্যু তৈরিতে না জানি কত গাছ কাটতে হয়!

(চলবে)

লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়েচে ভেলে, বাংলা বিভাগ

ইমেইল  amrita.modak81@gmail.com

অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!