এ মরুভূমিটির আয়তন সাড়ে ছয় লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। ইয়েমেন,ওমান,সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবকে এক বিনিসুতোর মালায় গেঁথেছে যা।
এই মরুভূমির কেন্দ্রে গনগনে দুপুরে তাপমাত্রা থাকে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তখন সাহসী মরুচারী আরব বেদুঈনদের পদচারণাও এই মরুর প্রান্তসীমায় থাকে সীমিত। তবু এই ঊষর মরুতে যে গাছ-গাছালি,মরু ক্যাকটাসসহ বিভিন্ন ফ্লোরা-ফনার অস্তিত্ব আছে, মরুচারী প্রাণি আছে, তা বিজ্ঞানীদের কাছে রীতিমত গবেষণার বিষয়।
দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটিতে আছি। এখনও মনে পড়ে, প্রথম যেদিন ‘দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ (এখানে কোন ব্যক্তি বা শাসকের নামে কোন বিমানবন্দর নেই,যদিও দেশটিতে রাজতন্ত্র রয়েছে) -এর রানওয়ে স্পর্শ করল আমাদের বিমানের ফ্লাইটটি,তখন সময় ছিল মধ্য সেপ্টেম্বরের মধ্যাহ্ন।
ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেরিয়ে এলে দর্শনার্থীদের ভীড়ে খুব সহজে পেয়ে গেলাম আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে অপেক্ষমাণ মিস্টার অ্যালিকে। সৌজন্য বিনিময়ের পর অ্যালি হাত বাড়িয়ে যখন আমার সবুজ পাসপোর্টটা চেয়ে নিলেন, তখন খেলাম আর একটা ধাক্কা। হাতে-পায়ে বুঝি এবার পড়ে গেলো বেড়ী!
দুবাই থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল শারজাহ-আজমান সীমান্তবর্তী কোম্পানির তারকা হোটেল কোরাল বিচ। ঝকঝকে হাইওয়ে ধরে আমাদের গাড়ি সাঁই সাঁই ছুটে চলছে গন্তব্যে।
পথে দেখা হলো খোলা পিকআপে তাপদাহ থেকে বাঁচতে নাক-মুখ বাঁধা অভাগা বংলাদেশি শ্রমজীবীদের একটি দলের সাথে। আহা,এই প্রান্তিক মানুষগুলো যেখানেই যান, হয়ে পড়েন এক নেই-রাজ্যের বাসিন্দা!
শুরুতে যে ক’দিন শারজাহ ছিলাম ভিসা আর ওয়ার্ক পারমিটের জন্য, সে ক’দিন কাজের বাইরে রোদে বের হতাম কমই। এরপর চলে এলাম কর্মস্থল আবু ধাবিতে।
কিছুদিন পরই আবহাওয়া সহনশীল হল,এলো শীত। সে সময় শীতে ভারী বর্ষণ হতে দেখেছি। রাস্তাঘাট হাঁটুপ্রায় পানিতে সয়লাব হতেও দেখেছি। তখনও ওদের বৃষ্টি-বাদলের জন্য প্রস্তুতি ছিল না। আর তা না থাকায় স্যুয়ারেজ সিস্টেমও বর্ষার উপযোগী ছিল না। তাতে করে একটু বৃষ্টিতেই নাকানি-চুবানি অবস্থা হতো নগর-কর্তাদের। জমে থাকা পানি সেচা,রাস্তা শ্যাম্পু করা,রাস্তা শুকিয়ে ঝরঝরে করায় দিন-রাত কাজ চলতো। পরে অবশ্য উপযুক্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়।
তখন শীত মানেই ছিলো বৃষ্টি আর বৃষ্টি মানেই আরও শীত জাঁকিয়ে বসা। আর মরুভূমির দেশ মানে গ্রীষ্মে বেশি গরম আর শীতে বেশি শীত। মাঝখানে অনেকগুলো বছর শীত তেমন হয়নি। সবুজায়নের ফলে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে সহনীয় আবহাওয়া হয়। যদিও এদেশে টিপ্পনী কেটে বলা হয়, ‘আরবের আবহাওয়া-প্রকৃতি, তাদের মেজাজের প্রতিকৃতি!’
গ্রীষ্মে যেখানে এই উষ্ণমণ্ডলীয় দেশসংযুক্ত আরব আমিরাতে তাপমাত্রা ৪৬-৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি ওঠে,ঊষর মরুর লু-হাওয়া প্রাণকে করে ওষ্ঠাগত, সেখানে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে অর্থাৎ মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শৈত্য প্রবাহ উত্তর আমিরাতের সবচেয়ে উষ্ণতর আমিরাত রাসাল খাইমায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয় মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানকার ৬ হাজার ২৬৮ ফুট উঁচু জেবল জেইস পর্বত শীর্ষ তুষারে শুভ্র হয়ে যায়। পার্বত্য এলাকার প্রায় ৫ কিলোমিটার জুড়ে এলাকা ঢাকা পড়ে যায় তুষারের চাদরে।
সপ্তাহান্তে এ তাপমাত্রা মাইনাস ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে আসে। সারাদেশ জুড়ে হালকা বৃষ্টিপাত শৈত্য প্রবাহ ও বালি ঝড় বইতে থাকে। ঘন কুয়াশাযুক্ত বাতাসের গতিবেগ ছিল ৬০-৮০ কিলোমিটার। এ সময় সমুদ্রের ঢেউ ১৫ ফুট পর্যন্ত স্ফীত হয় বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়।
গেল সপ্তাহের শুক্র আর শনিবার সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশিসহ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হাজারও মানুষের ভীড় দেখা যায় জেবল জেইস পর্বত অভিমুখে। মরুর বুকে হঠাৎ একখণ্ড তুষারের দেশ পেয়ে তারা যারপরনাই আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন।
আমিরাতী তরুণ যুবারাও এতে এসে যোগ দেন। সবার কথা, ২০০৯ আর ২০১২ সালের তুলনায় এবারের তুষারপাত ছিল অনেক বেশি। আর বেশি তুষার মানেই তো বেশি আনন্দ।
যদিও এই বৈরী আবহাওয়ায় সারা আমিরাত ধুলোর আবরণে ঢাকা পড়ে যায়। শৈত্য প্রবাহ কিছুটা নাকাল করে জনজীবন। প্রচণ্ড বালিঝড়ের তাণ্ডবে সৃষ্ট লো-ভিজিবিলিটির কারণে এ সময় ট্রাফিক কমে আসে উল্লেখযোগ্য হারে। ব্যাহত হয় নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল। বন্ধ রাখা হয় দুবাই শপিং ফেস্টিভ্যালের জম্পেস ভেন্যু ‘গ্লোবাল ভিলেজ’।
এই লেখাটা লেখার সময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের তাপমাত্রা ১৮-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। দিনের বেলা যদিও সূর্যের দেখা মিলছে, কিন্তু তাতে শৈত্য প্রবাহ ও বালিঝড়ের তাণ্ডব খুব বেশি কমেনি।
লেখক: আবুধাবি প্রবাসী সংবাদকর্মী
ইমেইল: banglavisionuae@gmail.com
লেখকের আরও পড়ুন