অনেক ছবি তুলেছি। শুধু ছবিগুলো দেখালেই তো হবে না, অনেক কথাই বলার আছে। তাই আজকে আমার লেখক হয়ে যাওয়া।
জায়গাটা ছিল ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালা, ফরাসি ভাষায় ‘মোন্ত ব্লঁ’ বলা হয়। একপাশে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, একপাশে ইতালি আর একদিকে ফ্রান্সের শামুনি।
প্রথম গন্তব্য ছিলো ক্যাবল কার এবং পর্বতের শীর্ষ ছুঁয়ে দেখা। ভাগ্যদেবী যেন মুচকি হেসে বললেন, “দাঁড়া, বের করছি তোর পর্বত চূড়ায় যাওয়া!”
কাউন্টারের সুন্দরী মিষ্টি হেসে বললো, তিন বছরের কম বয়সি অভিযাত্রী দলে থাকলে শীর্ষ আরোহণ সম্ভব নয়! (কান ব্যথা করবে)।
মুখ কালো করে প্রথম ধাপে আরোহণ করলাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আগে যদি বুঝতাম, তাহলে ওয়াসফিয়া নাজনীন হতাম পাক্কা (উনি আমাদের গর্ব)।
বললে মানুষ হাসবে, আমার নিজের দেশ বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন এখনও দেখা হয়নি। সুন্দরবন দেখা হয়নি, রাতারগুল দেখিনি আমি।
শৈশবে যখন আব্বুকে বলতাম, “আব্বু চলো না আমাদের নিয়ে!”
উনি বলতেন, “তোমার পরীক্ষা শেষ হলেই যাবো।” নয়তো বলতো, “তোমার ছোট ভাইয়ের পরীক্ষার পর যাবো।”
যাবো যাবো করে উনি নিজেই চলে গেলেন একা না ফেরার দেশে। আমাদের আর যাওয়া হলো কই?
তাই আমি এখন নিজেকে বলি, যখন যেভাবে পারা যায় আনন্দ করো। দু’চোখ ভরে পৃথিবীর সব রূপ দেখে নাও, কখন আবার চলে যেতে হয়!
দ্বিতীয় গন্তব্য টুরিস্ট ট্রেনে করে পাহাড়ে ভ্রমণ। সেও ভারি মজার। এঁকেবেঁকে ট্রেন যাচ্ছে, আর আমরা ঢুকে যাচ্ছি রবিনহুড, সুন্দরী মারিয়ান, লিটল জনের শেরউড জঙ্গলে। হয়তো ট্রেনের উপর হামলে পড়বে ভ্যাম্পায়ার, নেকড়ে, জম্বি অথবা হ্যারি পটারের আজকাবান কারাগার থেকে পালিয়ে আসা প্রেতাত্মা।
ট্রেনে বসে ভাবনাগুলো যখনই ডালপালা মেলছিলো আমার দুই বছরের কন্যা দু’হাত ছড়িয়ে বলল, “মাম্মা, সিতুপ্লে (দয়া করে কি তাকে কোলে নিতে পারি)?”
কিছুক্ষণ পর ট্রেন থামলো, আমরা নামলাম। দেখতে গেলাম ‘মের দু লা গ্লাস’ বা ‘বরফের সাগর’।
যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা বরফ। সূর্যমামা প্রাণ খুলে হাসি দিলে রংধনু হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু সূর্যমামার মুখ ভার। তাই আমরাও গোমড়া মুখে হাঁটছি। হঠাৎ আমার পুত্রদ্বয়ের এই মুহুর্তেই টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। কি আর করা, খুঁজতে বের হলাম মসীহ টায়লেটকে!
স্কি করা হলো না উচ্চতার ভয়ে। স্লেজগাড়িতে ভ্রমণ হলো না দুর্গম রাস্তা, উচ্চতা এবং সবাই একসঙ্গে (৬ জন) উঠা যাবে না তাই। পোলাপান একটারে নিলে আরেকটা কান্দে!
পরে কোন একসময় আবার আসবো বাচ্চারা বড় হলে, আরিফ সান্তনা দিতে দিতে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
তৃতীয় গন্তব্য মালভূমি থেকে সমতল ভূমিতে যাত্রা। যাওয়ার আগে এদিকটার বাড়ির বর্ণনা দিয়ে ফেলি খানিকটা। বাড়িগুলো সব কাঠের তৈরি এবং অনেক সুন্দর। বাড়িগুলো দেখে বারবার মনে পড়ছিলো ওয়েস্টার্ন মুভির কোন সেট যেন- আউট ল, শেরিফ, বার ম্যান, কাউবয় ও গানফাইট। ডিসুম ডিসুম ডিসুম! কাঠের বেড়া এফোড় কি ওফোড়- উফফফ সে কি রোমাঞ্চ!
পর্বত পেড়িয়ে পাহাড়, পাহাড় পেড়িয়ে দিগন্ত, দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা জলরাশি- লেক দ্যানেসি, লেক অ্যানেসি। প্রাকৃতিক এই লেকের দুই পাশে দুটি শহর। আর এই শহরের মানুষদের পানির চাহিদা পূরণ হয় এই লেকের পানিতে। পুরো লেকটার আয়তন ২৭ কিলোমিটার।
আর মনে মনে বললাম, ‘আবার আসিব ফিরে।’
দীপ আমাকে কিছু স্যুভিনর কিনে দিয়েছিলো। রুম-সার্ভিস সুন্দরী মেয়েকে পটাতেই কিনা স্যুভিনর ও টিপস সে হোটেল রুমে রেখে এসেছে! দীপের ভাষ্যমতে, সে ভুলে ফেলে এসেছে।
ঘটনায় যথারীতি আমি ক্ষুদ্ধ এবং বিলাপ করেই যাচ্ছি- আমার স্যুভিনর আমার স্যুভিনর! বিশাল হৃদয় পতি মুচকি হেসে কহিল, ‘আবার যখন যাবো, তখন নিও হানি!’
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |