জার্মানির বন শহরের পথে পথে

আগেই বলেছিলাম- ভাইবার, স্কাইপ, হোয়াটস অ্যাপের এই যুগে দেশ ও প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে এত দূরে থাকা সত্ত্বেও আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করতাম না। নতুন বাসাতেও ওয়াই-ফাই নেওয়া হয়নি।

অমৃতা পারভেজ,জার্মানির বন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2017, 05:12 AM
Updated : 4 Feb 2017, 05:12 AM

স্মার্টফোন না কেনার কারণে ট্রামে-বাসে স্মার্টফোনে আসক্তদের দেখে মোটেও ভালো লাগতো না। বরং যারা বইয়ের পাতা উল্টাতেন, তাদের দেখতে ভালো লাগতো।

আমাদের দেশে ট্রেনে-বাসে বই পড়ার অভ্যাসটা এখন দেখাই যায় না। অথচ জার্মানিতে কিন্তু আপনি ট্র্রাম, বাস বা ট্রেনে সব বয়সি মানুষের হাতেই বই দেখবেন। আর ট্যাবে, কিন্ডলে বই পড়ার মধ্যে কি কোন আনন্দ আছে? বইয়ের গন্ধ নেই, ভালোলাগা নেই।

ট্রামের ভেতর ছোট ছোট অনেক ঘটনা ঘটে। যেগুলো দেখলে মন ভালো-খারাপ দুটোই হয়। ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে মা-বাবা যখন ট্রামে ওঠেন, তখন ছোটরা অনেক প্রশ্ন করে। কোনো বাবা-মাকেই তেমন বিরক্ত হতে দেখিনি। বিরক্ত করছে বলে হাতে ফোন বা ট্যাবলেট দিয়ে বসিয়ে দিতে দেখিনি। কি সুন্দর করে যে তারা বুঝিয়ে দেয়।

এখানকার বাবা-মায়েরা ছোট ছোট বই সঙ্গে নিয়েই বের হন। বাচ্চারা সাথে আছে আর বাবা বা মা ফোন গুতাচ্ছে- এমনটা দেখা যায় না। তাদের গল্প পড়ে শোনান। রাস্তায় মজার কিছু দেখলে বাবা-মা অনেক সময় নিজে থেকেই তার বর্ণনা দেয়। এছাড়া ট্রামে কীভাবে টিকেট কাটতে হয়, নামার সময় দরজার সুইচ কোথায় থাকে- এগুলো বাচ্চাদের দিয়েই করায় বেশিরভাগ সময়।

স্টেশনের নাম দেখানো, সময় দেখা- এসব ট্রামের মধ্যেই অনেকে শেখে। জার্মানিতে যে জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লাগে, তা হলো চলাফেরার সুবিধা। দৃষ্টিহীন, বাক প্রতিবন্ধী বা যারা হাঁটতে পারেন না, তাদের জন্যও চমৎকার ব্যবস্থা আছে। হুইল চেয়ারে করে ট্রেন, বাস, ট্রাম সবখানে চলাফেরা করতে পারবেন। রাস্তায় সিগনালের শব্দ শুনে ট্রাফিক সম্পর্কে ধারণা পান দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা। অনেক সময় ভিড়ের কারণে বসার জায়গা না থাকলে এবং কোন বয়স্ক কেউ বা অন্তসত্ত্বা কেউ থাকলে অনেকেই স্বেচ্ছায় আসন ছেড়ে দেন বা অন্তত জানতে চান?

আরেকটা জিনিস প্রায়ই দেখা যায়। ট্রাম হয়তো ছেড়ে দেবে, ট্রাম ধরার জন্য একজন দৌঁড়ে আসছে, ট্রামের ভেতর বা বাইরে থেকে কেউ দরজা আগলে দাঁড়ালো যাতে দরজা বন্ধ না হয় এবং যাত্রীটি ট্রামে উঠতে পারে।

ট্রামে জোন ভাগ করা অর্থাৎ জোন অনুযায়ী ট্রামের টিকেটের দাম বাড়ে-কমে। আপনার হাতে ভারী ব্যাগ টানতে পারছেন না, কেউ নিজে থেকেই এগিয়ে আসবে। আর যদি দেখেন যে আসছে না, তবে একটু সাহায্যের আবেদন জানালে খুশি হয়েই আপনাকে সহায়তা করবে।

বন শহরে ট্রামের ভেতর টিকেট কাটার ব্যবস্থা আছে, তবে কেবল পয়সা দিয়ে সেখান থেকে টিকেট কাটা যায়। নোট বা কার্ড ব্যবহার করা যায় না। কিছু কিছু ট্রাম স্টেশনে মেশিন আছে যেখান থেকে কার্ড বা ক্যাশ দিয়ে আপনি টিকেট কাটতে পারেন। এছাড়া আছে ৪ টিকেট, সপ্তাহের টিকেট, দিন ও মাসের টিকেটের ব্যবস্থা। আর যাদের সকাল ৯টার আগে বাইরে কোন কাজ নেই, তারা কাটতে পারেন ৯টার পরের মাসিক টিকেট, যেটা বেশ সস্তা। এই টিকেটে সকাল ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত ট্রাম-বাসে সফর করতে পারবেন আর শনি, রবিবার বা ছুটির দিন পুরোটা সময়।

আমস্টারডামের মত বন শহরেও কিন্তু প্রচুর সাইকেলপ্রেমী আছেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, কোন কমতি নেই। সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে সবাই- শিক্ষার্থী, কর্মজীবী বা হোন কোন মন্ত্রী।

অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন, বয়স হলে কেবল আমাদের দেশের মানুষরাই বেশি কথা বলে। না, এদেশেও ঠিক তাই। আপনি যদি জার্মান ভাষা জানেন এবং ট্রামে বা ট্রেনে উঠেছেন, আর আপনার সামনের সিটে কোন বুড়ো বা বুড়ি বসেছে, তাহলে কথাটা শুরু হবে এমনভাবে আজকের দিনটা কি সুন্দর বা আজ এতো ঠাণ্ডা পড়েছে, অথবা এত গরম কেন? অর্থাৎ আবহাওয়া দিয়ে কথা শুরু, এরপর আপনি যদি চালিয়ে যেতে পারেন, পুরো পথে কথা বলে যাবে।

ট্রাম যদি দেরিতে আসে, সে বার্তাও আপনি পেয়ে যাবেন অ্যাপে বা ট্রাম স্টেশনে। বন শহরে ট্রাম আমার অন্যতম পছন্দের জিনিস। কেননা মন খারাপ হলেই ট্রামে চেপে চলে যান দূরে, যেখানে গেলে মন হয়ত এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। অথবা ট্রাম ঘুরতে থাকবে আর আপনার হাতে থাকবে বই। পড়তে পড়তে মন খারাপের মেঘটা সরে যাবে...

(চলবে)

লেখক:

এডিটর অ্যান্ড মডারেটর,ডয়েচে ভেলে,বাংলা বিভাগ

ইমেইল: amrita.modak81@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: অমৃতা পারভেজ

অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন