গর্ভে সন্তান নিয়ে পাহাড়ের উপর হেরা গুহায়

ভ্রমণ কম বেশি সবারই শখের বিষয়। বাচ্চাদের মাঝে এই শখ আরও প্রবল। যেসব বাচ্চা খুব কান্নাকাটি করে, দেখা যায় তাদেরকেও একটু ঘুরতে নিয়ে গেলে শান্ত হয়ে যায়।

লিজিয়ানা মদীনা, যুক্তরাজ্য প্রবাসীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Feb 2017, 11:08 AM
Updated : 2 Feb 2017, 11:08 AM

আমি খুব ছোটকাল থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমার একটা চাকরি হলে টাকা জমিয়ে শুধু দেশ-বিদেশ ঘুরব। এখন কিছু টাকা হাতে জমলেই সঙ্গী নিয়ে অচেনা দেশের ভিসার জন্য ছোটাছুটি করি। চাকরির সুবাদে প্রায়ই আমাকে দেশের বাইরে যেতে হয় বা প্রবাস জীবন কাটাতে হয়।

গত বছর আমার সুযোগ মিলেছিল সৌদি আরবের জেদ্দা ভ্রমণের। চিন্তায় ছিলাম যাব কি যাব না! কারণ আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বন্ধুমহলে মোটামুটি সবাই আতঙ্কিত। আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এমন একটা দেশ ভ্রমণ কীভাবে হাতছাড়া করি! তাছাড়া ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে এই দেশের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক।

চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। গুগলে অনেক ঘাঁটাঘাটি করে দেখলাম, তেমন কোনও সমস্যা আছে কি না। সব ভেবে দেখলাম, আসলে যাওয়া যায়। তবে এরকম অবস্থায় একটি ডাক্তার সার্টিফিকেট অবশ্যই নিতে হবে, নয় তো প্লেনে ভ্রমণ করা যাবে না।

আমরা যখন ট্রানজিটের জন্য নামলাম আবুধাবিতে, ইমিগ্রেশনের সিকিউরিটি ডিভাইস আমাকে আটকে দিল। সিকিউরিটির মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি প্রেগনেন্ট কি না?”

আমি 'হ্যাঁ' সূচক উত্তর দিলে সে আমার চিকিৎসকের সার্টিফিকেট দেখতে চাইল। আমি সার্টিফিকেট দেখালে তবেই মেয়েটি আমাকে যেতে দিল। যথাসময়ে মনের জোরে পৌঁছলাম জেদ্দায় সহকর্মীদের নিয়ে।

‘জেদ্দা’ বা ‘জেদ্দাহ’ হল সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত তিহামাহ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এটি মক্কা প্রদেশের সর্ববৃহৎ ও সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। লোহিত সাগরের উপর অবস্থিত সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এ শহরেই অবস্থিত।

৪৩ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে শহরটি সৌদি আরবের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। জেদ্দা হলো মুসলিমদের জন্য পবিত্রতম নগরী মক্কার প্রধান প্রবেশদ্বার। জেদ্দায় আছে নজরকাড়া ও মনোমুগ্ধকর অসংখ্য পাবলিক আর্টস।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পাবলিক আর্টসগুলো হলো ফিনিশ শিল্পী এইলা হিল্টুনেন -এর ‘সানফ্লাওয়ার ফিল্ড ফাউন্টেন’, মুস্তাফা সেনবেল ও মোহাম্মদ সাঈদ ফারসির ‘ফিসারমেনস্ নেট’, সিজার বালদাচিনির ‘দি আই ’ এবং হিশাম সাঈদ বেনজাবি ও আলি আমিনের ‘ইঞ্জিনিয়ার টুলস্ স্কাল্পচার’। সব মিলিয়ে যেন এক শিল্পিত ভাস্কর্যের শহর এই জেদ্দা।

আমরা জেদ্দায় পৌঁছানোর পর অফিসে জয়েন করলাম। সপ্তাহে দু’দিন সময় পেতাম ঘোরার জন্য। জেদ্দায় সবচেয়ে সস্তার মার্কেট হলো ‘বালাদ মার্কেট’। আমার কাছে বাংলাদেশের ‘নিউ মার্কেট’ মনে হয়েছে। অনেক বাংলাদেশি সেখানে ব্যবসা করে। তবে দামাদামি করে জিনিস না কিনলে আপনি ঠকবেন।

জেদ্দা থেকে মক্কা মাত্র এক ঘণ্টার পথ। মক্কায় গিয়ে ওমরাহ্‌ করলাম। এরপর আমাদের মিশন ‘হেরা গুহা’। হেরা মক্কা থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে জাবালে নূর পর্বতে অবস্থিত। অনেকেই আমাকে বাঁধা দিল কিন্তু প্রাণের টানে বাধ্য হলাম। মনে শুধু সেই গানটি বাজছে-

“হেরা হতে হেলে দুলে
নুরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা
খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা,কামলিওয়ালা।”
পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা আসলেই কষ্টকর। পাহাড়ে উঠতে উঠতে দেখলাম এক ভারতীয় তার পিঠে বাচ্চা নিয়ে ওপরে উঠছে। মোটামুটি সে হাঁপাচ্ছে। আমি তাকে বললাম (হিন্দিতে), “তোমারে পিঠে বাবু আর আমার পেটে বাবু।”

ভারতীয় বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে আমাকে বলল, “তোমার এ অবস্থায় উপরে ওঠা একদম উচিৎ হয়নি।”আমি বললাম, “কি করব বলো, মন যে খুব চাইলো।”

আমার প্রায় দেড়ঘণ্টা লেগেছিল গুহার কাছে আসতে। ওপরে উঠতে উঠতে দেখা যাবে বানরের দাপাদাপি। অর্ধেকের মত পথ গেলেই দেখা যাবে বানর আর বানরের কিছু বাচ্চা। হাতে খাবার, পানি বা অন্য কিছু থাকলে এরা কেড়ে নিয়ে যাবে।

মাঝপথে একটি দোকান আছে যেখানে হালকা খাবার পানি পাওয়া যাবে। আমরা সেখান থেকে কয়েকটা লাঠি নিয়ে নিলাম যেন বানর তাড়াতে পারি। গুহাটি পর্বতের ৮৯০ ফুট উপরে ৩ দশমিক ৭ মিটার (১২ ফুট) দীর্ঘ এবং ১ দশমিক ৬০ মিটার (৫ ফুট ৩ ইঞ্চি) প্রশস্ত।

মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এই গুহাতেই ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এখানেই তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুয়্যতপ্রাপ্ত হন এবং এখানে সর্বপ্রথম কোরাআনের পাঁচটি আয়াত নাযিল হয় বলে ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে।

প্রাণভরে প্রিয় নবীর সে আসনটিতে বসে দুই রাকাত নফল নামায আদায় করলাম। আমাকে দেখে অনেকেই হেরা গুহা দেখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতো উঁচুতে দেখে আমার পুরুষ সহকর্মীরা যারা গুহাতে যাওয়ার চিন্তাও করেনি, তারাও পরের বার হেরা গুহায় গিয়েছিলেন।

আমার একজন প্রিয় সহকর্মীর একটি উক্তি এখানে না বললেই নয়। তিনি বলেছিলেন, একজন মহিলা, তাও আবার প্রেগন্যান্ট, তিনি যদি সাহস করতে পারেন এক হাজার ফুট উপরে ওঠার, তাহলে আমরা কেন পারবো না? তারা সত্যি সত্যি এ কথার জের ধরে সেই জাবালে নূর বেয়ে হেরা গুহাতে পৌঁছেছিল।

ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরূত্বপূর্ণ জেদ্দা নগরীতে আরও অনেক কিছু আছে দেখার মত। আমরা সেই ট্যুরে সব কিছু দর্শন করে আসতে পারিনি। ইচ্ছে আছে পরবর্তীতে কোন সুযোগ পেলে বাকিগুলোও দেখে আসব ।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ই মেইল-naeema23aziz@gmail.com

ছবি: হেরা গুহার ওপরের দৃশ্য

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!