সেপ্টেম্বরে আমি ওবারকাসেলে চলে আসায় ওদের অ্যাপার্টমেন্টে আড্ডা হয়। এক শুক্রবারে আমরা গান চালিয়ে নাচানাচি করছিলাম।
সোমবার অফিস খুলতেই বস গ্রেহেম লুকাস ডেকে পাঠালেন তিনজনকে। আমার বান্ধবীদের বাড়িওয়ালা অফিসে কমপ্লেইন করেছে যে দুইজনের কথা বলে ওই বাড়িতে তিনজন থাকে আর হইচই করে।
বিনিশ কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও ইসরা একেবারেই নির্ভিক। বললো, টাকা (ইউরো) দিয়ে থাকছি, এত কিসের ভয়! যাহোক, এরপর ওদের ওখানে গেলেও আমরা নাচানাচিটা বন্ধ রাখলাম।
আমার সহকর্মী আরাফাত ভাই বললেন, ব্লাইন্ড বুকিং করতে পারেন।
এটা আবার কি জিনিস!
তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ব্লাইন্ড বুকিং-এ একটা নির্দিষ্ট টাকা দেখাবে। হয়তো ৩৯ বা ৪০ ইউরো। তারপর অপশন দেবে পাঁচটা জায়গার, সেখান থেকে পছন্দ করলে সেই জায়গা অনুযায়ী তারা আরও কিছু ইউরো যোগ করবে টিকেটে।
আমাদের কারও কাছে ক্রেডিট কার্ড নেই। আরাফাত ভাই বললেন, তিনি আমাদের টিকেট কেটে দিতে পারেন। আমরা তাকে পরে ক্যাশ দিয়ে দেব।
যাই হোক, প্রথম পাঁচটি অপশনে মিলান,ভেনিস,অ্যামস্টারডাম,লিসবন আর জুরিখ ছিল। আমরা সুইজারল্যান্ড যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। টিকেটের দাম হল, জনপ্রতি ৮৭ ইউরো। কোলন থেকে ফ্লাইট পরদিন সকালে।
আমার বান্ধবীরা বললো, আমরা একসাথে থাকবো। কারণ কাল সকাল সকাল বের হতে হবে।
‘মাছরাঙ্গা টেলিভিশন’-এর শুরু থেকেই সেখানে কাজ করেছি। শুরুতে প্রযোজনা বিভাগে একদল তরুণ ছেলে এসেছিলো,যারা প্রত্যেকেই ভীষণ কর্মঠ। আট ঘণ্টার জায়গায় ওরা ১২,১৪ এমনকি ২৪ ঘণ্টা কাজ করতেও দ্বিধা করতো না। এই দলটিতেই ছিলো উল্লাস।
উল্লাসের ফোন নাম্বারও ছিলো। তাই ফোন করে জানালাম যাচ্ছি জুরিখে। ও জানালো, কোন অসুবিধা নেই,ওর বাসাতেই আমরা থাকতে পারবো। একদিনের ব্যাপার, ম্যানেজ হয়ে যাবে।
আমাদের আনন্দ দেখে কে! রাতে উত্তেজনায় ঠিকমত ঘুমই হলো না কারও। সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি,এতো স্বপ্নে ভেবেছিলাম! আর দেখেছি হিন্দি সিনেমার গানে।
ভোরে উঠে আমরা ট্রাম ধরে বাস স্টপে গিয়ে বিমানবন্দরের বাসে উঠলাম। এয়ারপোর্টে গিয়ে চেকইন করে প্লেনে উঠে বসলাম। এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম জুরিখ, সুইজাল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহরে।
ফোন করলাম উল্লাসকে। ও বললো, ট্রেন ধরে সেন্ট্রাল স্টেশনে আসতে, ও সেখানেই আছে। আমরা স্টেশনে পৌঁছে দেখি উল্লাস দাঁড়িয়ে। কি যে আনন্দ হলো ওকে দেখে! বহুদিন পর আবার কোন পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা।
আমাদের হাতে একটাই দিন। তাই হালকা নাস্তা করে আমরা শহর পরিভ্রমণে বের হলাম।
উল্লাস তখনও চাকরি পায়নি,চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশিরা অতিথিপরায়ণ, উল্লাসও সেই ধারাই বজায় রাখলো। বিশেষ করে খাওয়ার ক্ষেত্রে সে কোন টাকা (ফ্রাঙ্ক) আমাদের খরচ করতে দিল না।
এরপর আমরা ঠিক করলাম, জুরিখ লেকটা আগে ঘুরে দেখি। আট ফ্রাঙ্ক করে টিকেট কেটে জাহাজে চড়লাম। ৪৫ মিনিটের ভ্রমণ।
লেক ঘুরতে ঘুরতেই সন্ধ্যা নেমে গেলো। সন্ধ্যা মানে সাড়ে আটটা বাজে। সেই ভোরে উঠেছি। তাই তিনজনই ক্লান্ত ছিলাম। সিদ্ধান্ত হল, বাসায় ফিরব। ট্রামে চেপে উল্লাসের বাসায় গিয়ে উঠলাম।
উল্লাসের মা এতোরকম রান্না করেছিলেন,জার্মানি আসার পর এত ভালো খাওয়া খাইনি। ওর বাবা-মা দুজনেই ভীষণ যত্ন করলেন আমাদের। উল্লাসের মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে সেখানেই ঘুমালাম। সকালে নাস্তা করে উল্লাসের মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে।
এবার পুরনো জুরিখের অলি-গলি ঘোরা হলো। পুরনো শহর আমার বরাবরই পছন্দের। নতুন ধাঁধা লাগানো চকচকে অট্টালিকা দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগে না। তাই ছোট্ট পুরাতন জুরিখ ভালোই লাগল আমার।
লিন্ডস চকলেট ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে আমরা হাঁটলাম অনেকটা। (চকলেট যে আমার ভীষণ পছন্দ তা আগেই বলেছি)
এরপর রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের দিকে। এয়ারপোর্টে চেকইন করার পর হঠাৎ উল্লাস কোথায় যেন চলে গেল। এদিকে দুপুর ১টায় আমাদের ফ্লাইট। একদম সময় নেই।
ভালোভাবে ওকে বিদায় জানানো হলো না। উল্লাস বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমরা ওকে পেছনে ফেলে দৌঁড়ালাম। সিকিউরিটি চেক-ইন করে এক দৌঁড় দিচ্ছি, তখন আমাদের নাম ঘোষণা হচ্ছে।
ঠিক দুই মিনিট আগে আমরা প্লেনে ঢুকে নিজের সিটে বসে হাঁপাতে লাগলাম। তারপর আমাদের যে হাসি শুরু হলো, তা আর থামতেই চায় না। আসলে সেই হাসি ছিলো আতঙ্কের অবসানের।
(চলবে)
লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর,ডয়েচে ভেলে,বাংলা বিভাগ
ইমেইল: amrita.modak81@gmail.com
ছবি কৃতজ্ঞতা: অমৃতা পারভেজ
অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |