পাকিস্তানের ‘মুসা কা মুসাল্লা’ : তুষারপর্বতের চ্যালেঞ্জ

ছবিতে দেখে আসা কিছু জিনিস, মনে হয়েছিল হয়তো ছবিতেই দেখে যাব আজীবন। কিন্তু না, শেষ অবধি বাস্তবে দেখা মিলল বহু প্রতিক্ষীত সেসবের কিছু অংশ। ছবির চেয়েও বহুগুণ সুন্দর সে দুনিয়া, মুসা কা মুসাল্লা!

রাশীদ আরশাদ, পাকিস্তান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2017, 08:54 AM
Updated : 19 Jan 2017, 08:54 AM

পাকিস্তানের কেপিকে প্রদেশের কাগান ভ্যালির সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া। নামেই একগুচ্ছ গল্পের আভাস। সে সব গল্পের একটি হল, মুসা নামে স্থানীয় এক মেষপালক এই পর্বতের চূড়ায় নামায পড়ত। সে থেকেই এর নাম হয়ে যায় ‘মুসা কা মুসাল্লা’ অর্থাৎ ‘মুসার জায়নামাজ’।

হিমালয় পর্বতমালার অন্তর্ভুক্ত ৪ হাজার ৮০ মিটার উচ্চতার এই পর্বতচূড়া পর্যটকবান্ধব অবস্থানের কারণে পাকিস্তানের পর্বতপ্রেমীদের কাছে সুপরিচিত। প্রতি বছর হাজারও পর্যটক এখানে আসেন ট্র্যাকিং-এর রোমাঞ্চ উপভোগ করার জন্য।

একটা বড় অংশ আসে ভরপুর শীত মৌসুমে তুষারপাতের মধ্যে অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে। ভ্রমণসংস্থাগুলো এর নাম দিয়েছে ‘‌উইন্টার সারভাইভাল’। ট্র্র্যাকিং-এর অভিজ্ঞতাশূন্য আমার পক্ষে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিনই ছিল।

পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমার বাংলাদেশি সহপাঠীদের অনেক অনুরোধ করেও সঙ্গী হিসেবে পেলাম না। ফলে ‘‌‌‌‌‌অ্যাডভেঞ্চার ট্র্যাকার্স’ নামে একটি ভ্রমণসংস্থার দ্বারস্থ হতে হল।

নির্ধারিত দিনে লাহোর থেকে পর্যটক নিয়ে আসা এই ভ্রমণ দলটি আমাকে ভোর ৪টায় ইসলামাবাদ থেকে তুলে নিল। বাসে উঠেই ঘুম দিলাম আমি। হরিপুর, অ্যাবোটাবাদ পার হয়ে মানসেহরা শহরে ঢোকার পর ঘুম ভাঙল আমার।

বাস চলছিল ঐতিহাসিক কারাকোরাম হাইওয়ে ধরে। রাতের আঁধার কেটে যাওয়ার পর দেখলাম পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলছি আমরা। দেখতে দেখতেই শুরু হয়ে গেলো তুষারপাত। নিমিষেই সাদা হয়ে গেল গাছপালা, ঘরবাড়ি।

কিছুদূর যেতেই আটকা পড়লাম। বরফে রাস্তা বন্ধ,হাঁটা শুরু করল সবাই। গন্তব্য ‘মান্ডা গুচ্চা’ নামে একটি গ্রাম। ‘‌‌‌মান্ডা গুচ্চা’তে নাস্তা সেরে শুরু হল ট্র্যাকিং। দু’দিনের এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে ট্র্যাকিং এবং ক্যাম্পিং-এর সরঞ্জাম নিয়ে যেন যুদ্ধযাত্রায় নামলাম আমরা। সহযোগী হিসেবে যোগ দিলেন পাহাড়ি কিছু পোর্টার আর মালপত্রবাহী ঘোড়া।

ঘণ্টাখানেক পর একটা ঝরনার মুখোমুখি হলাম। তবে হাতমোজা খুলে পানিতে হাত দেওয়ার দুঃসাহস হল না। ইতোমধ্যে মাইনাস তাপমাত্রা, তার উপর হাইকিং-এ অনভ্যস্ততার দরুণ বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

হালকা বিশ্রামের পর এবার আসল চ্যালেঞ্জের পালা। তুষারপাত আগের মতই চলছে। হাঁটু সমান বরফের মধ্যে দিয়ে আমরা ধীর লয়ে উপরে উঠছি। আনুমানিক চার ঘণ্টা ট্র্যাকিং-এর পর ‘ধোড়’ নামে একটি এলাকায় পৌঁছালো আমাদের পর্যটক দলটি। এখানেই আমাদের রাত্রিযাপনের জন্য ক্যাম্পিং-এর ব্যবস্থা করা হল।

জায়গাটার সৌন্দর্য সম্পর্কে যত বলি না কেন, কম হবে। বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ি এলাকায় একটা ছোট্ট সেতু,তার ওপাশে দুই-তিনটা ছোট ঘর যা গ্রীষ্মকালে রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাড়িঘরের ছাদে বরফের স্তুপ।

দলের অগ্রদূত গাইড ও পোর্টাররা মিলে কাঠ জড়ো করে আগুন জালালো। উষ্ণতার খোঁজে আমরা যে যেভাবে ছিলাম সেভাবেই আগুনকে ঘিরে বসলাম। ততোক্ষণে তাবু টাঙ্গানো হয়ে গেছে। রান্না-বান্না অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটলো।

বাইরে তখনও তুষারপাত থামেনি। আবহাওয়া ক্রমান্বয়ে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুষারপাত মাত্রাতিরিক্ত হলে আমরা আটকা পড়ে যেতে পারি, এমনটাই ভাষ্য ছিল অনেকের। আনুমানিক মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি তাপমাত্রার সেই রাতে শীতের সাথে লড়াইটা হয়তো কোনদিনও ভুলব না!

সকালে খুব স্বল্প সময়ের জন্য সূর্য উঁকি দিল। কিন্তু অবিরাম তুষারপাতের ধারা অব্যাহতই থাকলো। আমরা প্রায় ২ হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছিলাম তখন। পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল ‘খোড়ি’ এবং ‘গালি’ নামক এলাকা পার হয়ে ‘মুসা কা মুসাল্লা’র চূড়ায় আরোহণ করা। কিন্তু অতিরিক্ত তুষারপাতের দরুণ রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

গাইড ও পোর্টাররাও সংশয় প্রকাশ করলেন। অবশেষে তাদের কথাই সত্য হল। কিছু পথ উপরে উঠতেই দেখি বরফ প্রায় কোমর সমান উচ্চতায় দাঁড়িয়েছে। ফলে আবারও ধোড়ের ক্যাম্পে ফিরে আসতে হল। সন্ধ্যার পর আগুন ঘিরে সবাই বসলাম। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা একে অপরের সাথে ভাগ করে নিলাম। ভ্রমণের আনন্দটা এই অংশে বেড়ে গেল।

আমি একজন বাংলাদেশি, এই পরিচয়টা তাদের দিলাম। তারা সবাই বেশ অবাক হলো। তারপর নিজেদের কৌতুহল থেকে নানান প্রশ্ন করল তারা। নিজেকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছিল তখন। ভ্রমণ সঙ্গীদের প্রায় সবাই ছিল পাঞ্জাবি। ফলে সেই রাতে পেশোয়ারী রুটির বদলে অনেকদিন পর ডাল-ভাত দিয়ে ভোজন করার সুযোগ পেলাম।

পরদিন সকালে সূর্য পুরোদমে দেখা দিল। সূর্যের কিরণমালা যখন গাছের ফাঁক গলিয়ে শুভ্র বরফের উপর প্রতিফলিত হল, তখন এক নিমিষেই যেন ভ্রমণের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মৃদু শীতল হাওয়া আর সূর্যের মিষ্টি আলো মিলেমিশে এক কাব্যিক পরিবেশ তৈরি করেছিল! কবি হলে নিশ্চয় কোন কালজয়ী কবিতার জন্ম হত সেদিন। সে এক অপূর্ব মুহূর্ত!

পাহাড়ের ঢালে বরফ ভেঙ্গে নিরন্তর পথ চলা আর মাইনাস ঠাণ্ডায় তাবুতে দুই রাত অতিবাহিত করার পর এবার বাড়ি ফেরার পালা। সূর্যোদয়ের ফলে বেশ আরাম লাগছে এখন ট্র্যাকিং করতে। গন্তব্য সেই ‘মান্ডা গুচ্চা’।

ফেরার পথে পাহাড়ি শিশুরা আমাদের দেখা মাত্রই কাছে এসে সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা তুষারের চেয়েও শীতল প্রশান্তির অনুভূতি দিয়েছিল তখন।

বরফ গলতে শুরু করেছে অনেক জায়গায়। ফলে তেমন বাঁধা ছাড়াই অল্প সময়ে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। বরফে ভিজতে ভিজতে পা দুটো ফুলে গিয়েছিল। অনভ্যস্ত শরীরেও তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলাম।

গাড়িতে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনে হচ্ছিল, এখন চোখ বন্ধ করলে হয়তো মাসখানেকের আগে আর খুলবো না,এতোটাই ক্লান্ত ছিলাম।

এভাবেই শেষ হল জীবনের প্রথম পাহাড়ি রোমাঞ্চের অধ্যায়টি। স্মৃতির পাতায় নিঃসন্দেহে অমলিন হয়ে থাকবে ‘স্নো হাইকিং’ আর ‘উইন্টার সারভাইভাল’-এর এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাটি।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি পেশোয়ার