বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ একটি চিঠি ছাপানোর মধ্য দিয়ে। তারপর তারা মালয়েশিয়ায় এক বাংলাদেশি শ্রমিকের নিহত হওয়ার খবর গুরুত্বের সঙ্গে ছাপায়। তাদের সে সংবাদ নিয়ে আমরা এখানে কর্মরত শ্রমিকরা একজোট হয়ে অনুদান তুলি। তা আবার বার্তা সংস্থাটির প্রতিনিধির মাধ্যমেই অর্থ পৌঁছে দেই নিহতের পরিবারের কাছে।
এ খবর প্রকাশ হলে আমরা বিস্মিত হই। আমরা যারা প্রবাসে থাকি দেশের জন্য তাদের টানটা আসলে লিখে বোঝানো যাবে না।
সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে থেকে জানানো হলো, তাদের এক সহকর্মীর ভাই মালয়েশিয়ায় আছেন, ২০ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। ছেলেটির পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়েছে জানিয়ে প্রবাস ডেস্ক থেকে অনুরোধ করা হলো কোনওভাবে খোঁজ নেওয়া যায় কি না!
'বাংলার নতুন সেনা'র বয়স বেশি নয়, এই তো গত ডিসেম্বরেই জন্ম। তবে প্রবাসে বিশেষ করে মালয়েশিয়ার মত দেশে, শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ঐক্য অনেক বেশি। আমাদের মধ্যে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে, যে বৈধ-অবৈধ সব বাংলাদেশির বিপদেই এগিয়ে আসা।
'বাংলার নতুন সেনা'র যেখানে জন্ম সেই পেরাক জেলা থেকে কুয়ালালামপুরের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফোন পেয়ে আমরা কুয়ালালামপুরে বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোনে যোগাযোগ শুরু করলাম।
কারণ ছেলেটি কুয়ালামপুরের কোতোয়ারা এলাকার বাংলা মার্কেট থেকে শেষ পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিল। নিখোঁজ ব্যক্তি এখানে অলিম্পিয়া কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। কলেজ থেকে ভর্তি বাতিল করায় তার ভিসাও বাতিল হয়ে গিয়েছিল।
যাই হোক ফোনে যোগাযোগ করে কোন গতি করতে না পেরে, আমাদের মধ্যে মালয়েশিয়ার বৈধ পাসপোর্টধারী রাসেল হাসান রাজুকে সংগঠনের তহবিল থেকে অর্থ দিয়ে কুয়ালালামপুর পাঠাই।
রাজু সেখানে বিভিন্ন সূত্র ধরে খোঁজ করে। কোতোয়ারার যে জায়গা থেকে ছেলেটি শেষ ফোন করেছিল, সেটি বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চল। সেখানে নানান লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর হ্যাঁ, এ পুরো কাজটায় কুয়ালামপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাও আমাদের দারুণ সহায়তা করেছিলেন।
তার পরামর্শেই উপায় না দেখে আমরা থানায় জিডি করি। জিডির ভিত্তিতে ইমিগ্রান্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায় যাকে খুঁজছি সে বাংলাদেশে চলে গেছে ১২ ডিসেম্বর।
আমাদের পক্ষ থেকে নিখোঁজের পরিবারকে সে সংবাদ জানানো হয়। পরে ছেলেটি শুনেছি পরিবারে ফিরে গেছে। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে যাওয়ার খবর আত্মীয় স্বজনরা কীভাবে নেয় সেই চিন্তায় ফিরে যাওয়ার খবর পরিবারকে জানাননি তিনি।
অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ধরতে এখানকার পুলিশ প্রায়ই অভিযান চালায়। বাংলাদেশিদের ধরে জেল-জরিমানার ঘটনা একেবারে নিত্য-নৈমিত্তিক। কিছুদিন আগে এরকম একটা পুলিশি অভিযান থেকে বাঁচতেই টিটু নামের এক বাংলাদেশি শ্রমিক একটি ভবন থেকে লাফ দেয়। পরে সে পালাতে পারলেও পা ভেঙে ফেলে।
বিদেশ বিভুঁইয়ে ছেলেটার দায়িত্ব নেন 'বাংলার নতুন সেনা'র সক্রিয় সদস্য ইদ্রিস। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইদ্রিস মালয়েশিয়ায় আছেন। একেবারে না হাঁটতে পারা, এমনকি পা কেটে ফেলার আশঙ্কায় থাকা টিটু এখন মোটামুটি সুস্থ। ইদ্রিসের নেতৃত্বে 'বাংলার নতুন সেনা'র সদস্যরা তাকে প্রতিনিয়ত সাহস ও শক্তি যুগিয়ে গেছে।
কিন্তু মালয়েশিয়ায় বাঙালির সমস্যা তো থেমে থাকে না। জীবিকার তাগিদে এখানে আসা শ্রমজীবী মানুষের বেশিরভাগই বৈধতা হারান। পুলিশি অভিযানের মুখে গ্রেপ্তার হন কিংবা জেলে যান।
সংগঠন চালুর পর প্রায় দুশো শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। আর প্রায় হাজারখানেক শ্রমিক পরোক্ষভাবে। মাত্র একমাসের মধ্যে এ সাড়া অভুতপূর্ব। তাই খুব সহজেই গ্রেপ্তারকৃতরা যে মালয়েশিয়ান মালিকের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, আমরা তাকে চাপ দিতে পারলাম; মুক্ত করতে পারলাম আটক করা তিনজনকে।
সবশেষ গত ১৬ জানুয়ারি আহত টিটুর সুস্থ হওয়া এবং 'বাংলার নতুন সেনা'র কাজকে আরও এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে আমরা একটি অনুষ্ঠান করি। যেখানে বক্তব্য দেন আওলাদ মাল।
"মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রবাসের যেকোনও বিপদে আমরা থাকবো বাংলাদেশিদের পাশে।"
'বাংলার নতুন সেনা'র অন্যতম উদ্যোক্তা রাজু জানান, প্রবাসে যেকোন ধরনের শ্রমিক উদ্যোগের সঙ্গে তারা রয়েছেন। এ লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে যে কেউ banglarnatunsena@gmail.com -এ যোগাযোগ করতে পারেন।
তিনি বলেন, " ইমেইলের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে মালয়েশিয়ায় সমস্যায় পড়া যেকোন ধরনের বাংলাদেশিকে সহায়তা করার চেষ্টা করবো। এছাড়া দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোকেও মালয়েশিয়া প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।
অনেক সময়ই আমরা এমন সমস্যায় পড়ি যা হয়তো দেশে থাকা শ্রমিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। ইমেইলে যোগাযোগ করলে আমরা সাহস ও শক্তি পাবো। এছাড়া যেসব সংগঠন প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যও 'বাংলার নতুন সেনা'র এ ইমেইল অ্যাড্রেসটি ব্যবহার হবে।"
দেশ থেকে অনেক সময়ই প্রবাসীদের খবরাখবর নেওয়ার কেউ থাকে না। কিন্তু এ প্রবাসেও আমরা বাংলাদেশ-মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করি। আমরা কাজ করে যাই, বাংলার মাথা উঁচু রাখতে। কেউ পাশে না থাকলেও মালয়েশিয়ায় আমরা আছি।