গভীর জলের জাহাজ আর ক্রুজ লাইনারগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দরটি 'মিনা ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল' মার্কেটকে ঘিরে। আরব আমিরাত প্রবাসী অনেক বাংলাদেশির জীবিকা জড়িয়ে আছে একে ঘিরেই।
প্রান্তিক শ্রমজীবী থেকে শুরু করে ছোট-বড় বিনিয়োগকারী অবধি- হরেক পেশার বাংলাদেশিরা আছেন এখানে। বাংলাদেশ থেকে কেউ এখানে আসার পর ভিন দেশের মাটিতে ইংরেজি ও আরবির পাশাপাশি হঠাৎ বাংলায় বিক্রেতাদের আহ্বান শুনে চমৎকৃত হতে পারেন ।
সেদিন শীতের এক মনোরম বিকেলে অ্যারাবিয়ান গালফের উথাল-পাথাল ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো সমুদ্র সৈকত লাগোয়া পাথুরে বাঁধের ওপর।
সামনে অবারিত জলধির বুকে অস্তমিত সূর্যের লালিমা যে এক নিটোল নিসর্গ চিত্রপট সৃষ্টি করেছে, তা দর্শনার্থীদের তনুমন না জুড়িয়ে কী পারে...! পাশে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্যে তারকাটা দিয়ে ঘিরে রাখা সমুদ্র বন্দর।
আগে জায়গাটা বিশাল উম্মুক্ত প্রান্তর ছিল। রিমোট নিয়ন্ত্রিত বিমান চালনা, মোটর-রেস, ঘুড়ি ওড়ানোসহ কতো কিছুর প্রতিযোগিতা আর উৎসবই না আয়োজন হত এখানে! হাতের কাছেই সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে আসা ভিনদেশি জাহাজের নোঙ্গর ফেলা। জাহাজের মাস্তুলে উড়ত কত, রঙ-বেরঙের দেশ-বিদেশের পতাকা।
কখনও কখনও জাহাজের ডেকে বসে থাকা বিদেশি নাবিকের দল এসে যোগ দিতেন ডাঙার মানুষের মেলায়। ভাষা বোঝার দায় যেন কারও নেই; সার্বজনীন সাংকেতিক ভাষা তো আছেই!
খুব বেশিদিন হয়নি নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেয়া হয়েছে পুরো বন্দরকে। এখন সেই সুযোগ হয়ে গেছে সীমিত।
সমুদ্র তীরের পাথুরে বাঁধের ওপর বসা একটি বাংলাদেশি পরিবারকে দেখে মন ভরে গেল। দেশের মানুষ বলে কথা! লেখালেখির খানিকটা অভ্যাসের কারণে আগ বাড়িয়ে চেনাশোনা করলাম তাদের সাথে।
এখানে বেড়াতে এসেছেন সপ্তাহ শেষের ছুটি কাটাতে। পরিবারটির সাথে চেনা হল, সখ্য হল। তাদের কাছে থাকার পুরো সময় জুড়ে যে জিনিসটা আকৃষ্ট করার মত তা হল বউ আর শাশুড়ির সে এক অপূর্ব মায়ামমতায় জড়াজড়ি করে থাকার দৃশ্য।
শিশুসুলভ সারল্যে বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিজ হাতে খাবার তুলে দেয়া, পাশে বসে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে প্রাণবন্ত গল্প কথায় মেতে ওঠা, হাত ধরে হাঁটা দেখে মনটা ভিজে গেল।
বউ-শাশুড়ির ভালবাসার এ হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য তাদের অনুমতি নিয়ে ক্যামেরা বন্দি করলাম। কারণ বহু ব্যাপারে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির হলেও আরব-আমিরাত নারীদের ইস্যুতে বরাবরই রক্ষণশীল।
এখানে এমনকি পাবলিক প্লেসেও বিনা অনুমতিতে নারীদের ছবি ক্যামেরা বন্দি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তো এই হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য দেখে ভাবলাম, আমাদের দেশেও তো আজ পাশ্চাত্যের অনুকরণে একান্নবর্তী সংসারের মূল্যবোধকে সেকেলে জ্ঞান করা হচ্ছে।
ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রমগুলো, আর এই বিদেশ বিভুঁয়ে এসে দেখলাম একেবারে অচিন দৃশ্য। যে দৃশ্য পশ্চিমে এবং মধ্যপ্রাচ্যে বাস করা বহু প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবারের দৃশ্যপট হতে একেবারে ভিন্ন।
আসলে প্রবাসীদের অনেকেই বৃদ্ধ মাকে বিদেশ নিয়ে যান সন্তানের 'ন্যানি' কিংবা 'বেবি সিটার' হিসেবে।
অথচ আবুধাবির এ ঘটনা- শাশুড়ি দেশে থাকলে অযত্ন হতে পারে বলে পুত্রবধূ নিজের কাছে এনে আপন সন্তানের মমতায় লালন করছেন দেখে আবেগতাড়িত হলাম!
একটাই তো জীবন আমাদের, একটু সহজভাবে সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে যদি যাপন করা যায়, কী এমন ক্ষতি তাতে!
লেখক: আবুধাবী প্রবাসী সংবাদকর্মী
ইমেইল: banglavisionuae@gmail.com
লেখকের আরও পড়ুন