পরদিন অফিস। সকালে অফিসে পৌঁছে সারাদিনের কাজ শেষে আবারও দেবারতিদি’র সঙ্গে গেলাম বন সেন্টারে। সেখানে তনুদিরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
এবার আমাদের বন এর সিটি সেন্টারে কী কী দেখার আছে তাই দেখার পালা। আমিও তখন আশপাশটা ভালো করে চিনি না। তাই আমার জন্যও এটা একটা ভালো সুযোগ।
বন এর একেবারে সিটি সেন্টারে বিশাল এক চার্চ আছে, ইউরোপের প্রতিটি ছোট বড় শহরে যেমনটা থাকে। চার্চের ভেতরটা ভীষণ গা ছমছমে। একদিকে মোমবাতি জ্বলছে। অন্যদিকে যিশু ও মা মেরির মূর্তি, সবকিছুই সুন্দর। কিন্তু কেমন ভুতূরে। হয়ত আলো স্বল্পতার কারণে।
চার্চ থেকে বের হলেই সামনে পড়বে বিটোফেনের স্ট্যাচু। হাতে একটা কাঠি নিয়ে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিটোফেন, দেখলে তাই মনে হবে। সামনে পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিসের পেছনের দিকে কিছুটা হেঁটে গেলে মিনি এশিয়া নামে একটা দোকান আছে।
সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের খাদ্যদ্রব্য এবং কসমেটিক্স পাওয়া যায়। দোকানটি ‘মদনের দোকান’ নামে পরিচিত। এই দোকানের মালিক মদন একজন আফগান। সেখান থেকে তনুদিরা টুকটাক কিছু জিনিস কিনলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশি কাঁচামরিচ, কারণ প্রাগে এটা দুর্লভ।
যে কেউ ইচ্ছে করলে চেয়ারে বসে নিজের ইচ্ছে মত বই নিয়ে পড়তে পারবেন, কোন নিষেধ নেই। উপরে ক্যাফে আছে। অনেকে এক পট চা বা কফি নিয়ে বই হাতে বসে যায়। অনেক শিক্ষার্থীকেও দেখেছি এখানে বসে নোট নিতে।
'থালিয়া' থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ সেন্টারের একদম কাছেই মূল ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসটা খুব একটা বড় না হলেও সামনে বিশাল মাঠ, পাশে রাইন নদীর কারণে জায়গাটা বেশ বড় দেখায়। প্রায়ই শিক্ষার্থীরা মাঠে বসে আড্ডা দেয়, কখনো ফুটবল বা অন্য কিছু খেলে।
সেন্টারের কাছেই অনেক মিউজিয়াম। বন এ এসে কেউ বিটোফেনের বাড়ি দেখবে না তা তো হতে পারে না! তাই আমরাও বিটোফেনের বাড়ি দেখবো বলে ঠিক করলাম।
১৭ বছর বয়সী কাউন্টেসা গুয়েলিটা গুইচ্চিআরদি নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন বিটোফেন। মেয়েটি বিটোফেনের ছাত্রী। শোনা যায় বিটোফেন মেয়েটিকে ‘মুনলাইট সোনাটা’ উৎসর্গ করেছিলেন।
আমার কাছে যে টিকেটের গোছা ছিলো সেখানে বিটোফেন হাউজেরও টিকেট ছিল। আর অন্যদের ৫ ইউরো দিয়ে টিকেট কাটতে হলো। সবাই ঢুকে পড়লাম বাসায়। ব্যাগ রেখে দিলাম লকারে। ইচ্ছে করলে কেউ 'অডিও গাইড' নিতে পারে। আমরা নিলাম না। মিউজিয়ামের ইতিহাস জানার জন্য কর্তৃপক্ষ যে হেডফোন আর রেকর্ডার দিয়ে দেয়, তাকে 'অডিও গাইড' বলে।
খুব ছোট ছোট ঘর, প্রতিটি ঘরে বিভিন্ন ছবি-চিঠি, কাগজপত্র, কোনটা পরিবারের কোনটা অন্য কোন সঙ্গীতজ্ঞের। একটি ঘরে বিটোফেনের মৃত্যুর সময় তার মুখের আদলে বানানো মূর্তি রাখা আছে।
এসব দেখে নিচে নামলে একটি ঘর রয়েছে দর্শনার্থীদের বসার জন্য, যেখানে বসে আপনি উপভোগ করতে পারবেন বেটোফেনের মুনলাইট সোনাটা বা অন্য কোন সঙ্গীত। হতে পারে সেটা নাইনথ সিম্ফোনি যা বাজানো হয়েছিল বার্লিন দেয়াল পতনের সময়।
বিটোফেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেবারতিদি জানালেন এবার তারা কোলনে ফিরবেন। কারণ পরদিন খুব ভোরে তনুদিদের ফ্লাইট কোলোন থেকে। এবার তনুদিদের সঙ্গে বিচ্ছেদের পালা।
ভীষণ মন খারাপ লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো অনেকদিনের চেনা কোন মানুষকে বিদায় দিতে হচ্ছে। হিয়া কান্না জুড়ে দিলো। বলতে লাগলো- ‘অমৃতাকে নিয়ে চলো, ওকে কেন রেখে যাচ্ছো।’
ওর কান্নার মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিলো। আর আমি শক্ত পাথর বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
(চলবে)
লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়েচে ভেলে, বাংলা বিভাগ
ইমেইল: amrita.modak81@gmail.com
ছবি কৃতজ্ঞতা: অমৃতা পারভেজ
অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |