কোলোনের চেনা-অচেনা চিড়িয়ায়, মজেছিলাম ক'জনায়

ড্রাখেনফেলস ঘোরার দিনই কথা ছিলো, পরের দিন কোলোনে খুব সকালে পৌঁছে যেতে হবে। ড্রাখেনফেলস ঘুরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেই ঘুম।

অমৃতা পারভেজ, জার্মানির বন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Jan 2017, 09:58 AM
Updated : 7 Jan 2017, 01:02 PM

পরের দিন সকালে উঠতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। রেডি হয়ে ট্রেন ধরে সোজা পৌঁছে গেলাম কোলোনে। স্টেশনে তনুদি, দেবারতি দি এবং বাকিরা উপস্থিত ছিল।

এবার আমাদের গন্তব্য নদীর ওপার। ফেরি করে নদীর ওপারে গেলাম আমরা। ভীষণ বড় আর সুন্দর একটা পার্ক।

গ্রীষ্মকালের রেশ তখনো কাটেনি। তাই বাচ্চারা মাটির মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ছুটির দিন, তাই অনেক মানুষের ভিড়। কেউ তোয়ালা বিছিয়ে স্বল্প বসনে বই পড়ছে। কেউ ‘বার বি কিউ’ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর যথারীতি অনেকেই দৌড়াচ্ছে বা জগিং করছে।

এখানকার যে বিষয়টা আমার ভীষণ ভালো লাগে, তা হলো বয়স্ক মানুষেরা সুন্দর ফিটফাট হয়ে বাইরে বের হয়। অর্থাৎ যারা কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন, তারা সুন্দর সেজে-গুজে পরিপাটি হয়ে ঘুরতে আসেন। ৭০-৮০ বছরের বৃদ্ধা লাল পোষাক পরে, মেকআপ করে, লাল লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে ঘুরে বেড়ান। তারা নিজেরা যেমন সেজে-গুজে সুখী থাকেন, তাদের দেখে অন্য সবারও বেশ ভালো লাগে।

আমাদের দেশে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বয়স যত কম, সাজের তত বাহার। অথচ অল্প বয়সে এমনিতেই ছেলে-মেয়েদের ভীষণ সুন্দর লাগে। প্রাণের উচ্ছ্বাসে টগবগ করতে থাকা তরুণ-তরুণীদের সাজার কোন দরকার পড়ে কি?

আর মেয়ে বা ছেলে বড় হতে থাকলে আমাদের মায়েদের সাজ কমতে থাকে। ৫০ বছরের বেশি বয়স হলে তো কথাই নেই, মায়েরা একেবারে হালকা বা সাদা শাড়ি আর বাবারা সাদা শার্ট। আর এখানে ৫০ তো যৌবন।

আমাদের বাবা-মায়েরা নিজেদের খুব দ্রুত বয়স্ক বানিয়ে ফেলেন। একটু ফিটফাট সাজ-গোজ করতে বললে বলবেন, এখন তো তোমাদের সময়। আরে আমাদের সময় বলে কি আপনাদের সময় ফুরিয়ে গেছে!

এখানকার মানুষের প্রাণশক্তি দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। ৭০-৮০ বয়স্ক মানুষগুলোকে যখন একা একা ট্রামে, বাসে,ট্রেনে চলতে ফিরতে দেখি তখন নিজেদের মনেও শক্তির সঞ্চার হয়। অবশ্য আমাদের দেশে চাইলেও এভাবে চলাচল করা সম্ভব না নানা কারণেই।

যাহোক, এবার আমাদের ঘোরার প্রসঙ্গে আসি। নদীর ওপারে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ‘কেবল কার’-এ চড়া। ‘কেবল কার’-এ উঠতে জন প্রতি লাগলো চার ইউরো। এই প্রথম আমার ‘কেবল কার’-এ চড়া। তাই উচ্ছ্বসিত ছিলাম।

উপর থেকে নদী, বিখ্যাত ‘কোলন ডোম’, মানে চার্চ আর পার্ক সব কিছু ছোট ছোট লাগছিলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম ওপারে। নেমে হাঁটতে লাগলাম। দেবারতিদিকে জিজ্ঞেস করলাম, যাচ্ছি কোথায়? বললো, গেলেই দেখতে পাবি।

একটা ছোট্ট হাঁটা ব্রিজ পেরিয়ে বাগানের মধ্য দিয়ে যেখানে এলাম, সেটা হলো কোলন চিড়িয়াখানা। পশু-পাখি আমার বরাবরই ভীষণ পছন্দ। তাই আমার খুশি দেখে কে? ওদের একটা অ্যাকুরিয়ামও আছে বড়।

টিকেট কাটা হলো। ১৭ ইউরো করে। টিকেট পাঞ্চ করে ঢুকতেই সামনে যে প্রাণিটির দেখা পেলাম, তাতে মনটা দমে গেলো। কেননা সচরাচর বোকা প্রাণি বলে অভিহিত এই প্রাণিটিকে তারা সামনে রেখেছে, হয়ত তাদের নানা গল্প গাঁথায় এর উল্লেখ আছে বলেই।

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। প্রথমেই গাধার সাক্ষাৎ পেলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কোন পশুদের খাঁচায় রাখা হয়নি। খোলা জায়গায় বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। আর চিড়িয়াখানাটা এত বড় যে মনে হবে বিরাট এক বনে এসে পড়েছি।

গাধাদের উল্টো দিকেই রয়েছে ঘোড়ারা। মনের সুখে খাবার খাচ্ছে।

হঠাৎ রোদের আলোয় এক লাল রঙের ঝলক এসে চোখে লাগলো। বা দিকে মুখ ফেরাতেই দেখি একরাশ ফ্লেমিঙ্গো। গলা লম্বা সরু পা পাখিগুলো একটা ছোট পুকুরের পাড়েই রয়েছে। কি যে অপূর্ব তাদের রঙ! এই চিড়িয়াখানায় এমন অনেক প্রাণির দেখা পেলাম বাস্তবে যাদের আগে কখনো দেখিনি।

ফ্লেমিঙ্গো

‘মিয়ারক্যাট’-এদের আচার-আচরণ কেমন যেন মানুষের মত। চার পেয়ে প্রাণিটা দু’পায়ে দাঁড়িয়ে যখন এদিক-ওদিক তাকায়, তখন মনে হয় যেন ভাব বিনিময় করছে।

মিয়ারক্যাট

মিয়ারক্যাটদের পেরিয়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ বেশ শোরগোল শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাচ্চারা সব হাকডাক করছে। দেখলাম বিশাল এক ভাল্লুক পাথরের ওপরে গাড়াগড়ি খাচ্ছে। আর তা দেখে বাচ্চারা হেসে লুটোপুটি।

ভাল্লুক

আর একটু সামনে যেতে দেখি ঠিক শুকরের মত দেখতে একটা প্রাণি, কিন্তু একটু ভিন্ন রকম। দেখলাম- নাম লেখা ‘টাপির’।

আর এর ঠিক পাশেই সুন্দর বিশাল লেজ দুলিয়ে অদ্ভুত এক প্রাণি মাটির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে কি যেন খাচ্ছিল, নাম লেখা ‘অ্যান্ট ইটার’। তার মানে সে পিঁপড়া খাচ্ছিলো মাটির মধ্যে থেকে।

অ্যান্ট ইটার

এবার শুনতে পেলাম সিংহের গর্জন। তবে এ জায়গাটা অন্যদের মত এতটা খোলা না। তারের বেড়া অনেক দূর উঠে গেছে যাতে পশুরাজ লাফ দিয়ে এপারে আসতে না পারেন। তবে তার যে আয়েশ, তাতে বোঝার আর বাকি থাকে না যে সে পশুদের রাজা।

সিংহ

দূর থেকে দেখা হলো চিতাবাঘের সঙ্গে। দুপুর হয়ে গিয়েছিল তাই তারা মাংস-ঘুম দিচ্ছিলো।

চিতাবাঘ

গরিলা, শিম্পাঞ্জি, বানর- এদের রাখা হয়েছিল বিশাল এক বাড়ির মধ্যে। তাদের বাড়িতে ঢোকার আগেই দেখা হলো দুই শিংওয়ালা গণ্ডারের সঙ্গে।

গণ্ডার

আমাদের পূর্ব পুরুষদের দেখতে দেখতে হাঁটছি, হঠাৎ দেখি একটি বিশাল মহিষের মত প্রাণি গম্ভীর হয়ে খোলা জায়গায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আসলে মহিষ না, ওটা ‘বাইসন’। বিশাল বিশাল কয়েকটা বাইসন এমনভাবে বসে আছে যেন এক একটা মূর্তি।

বাইসন

জিরাফদের দেখেও ভীষণ ভালো লাগলো। কেমন যেন নাক উঁচু মানুষের মত গলা উঁচিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। নিচে ছোট খাটো কাউকে পাত্তাই দিচ্ছে না।

দেখা মিললো সিল মাছদের।

সিল মাছ

এছাড়া ছিলো পেঙ্গুইন, নানা জাতের রঙ-বেরঙের পাখি... আরও যে কত কি দেখেছি! পুরো চিড়িয়াখানাটা এত বড় যে আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কেউ কেউ বেঞ্চ পেয়ে শুয়ে পড়ল। এতটা ক্লান্তিতে অ্যাকুরিয়াম দেখার ইচ্ছে আর কারও ছিলো না।

এতসব প্রাণী দেখে মন ভীষণ আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল আমাদের। চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে একটা পার্ক ধরে আমরা হেঁটে চললাম যার যার গন্তব্যের পথে…

(চলবে)

লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়েচে ভেলে, বাংলা বিভাগ

ইমেইল: amrita.modak81@gmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: অমৃতা পারভেজ

অমৃতা পারভেজের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!