ঘুরতে গিয়ে ফরাসি 'জামাই' পেলাম!

প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে বেশ কিছুদিন বাসা থেকে বের হইনি, কোথাও যাওয়া হয়নি। এবার ইউরোপে একটু বেশিই শীত পড়ছে, প্যারিসে প্রতিদিনের জীবনে ছাপ রেখে যাচ্ছে।

মোয়াজ্জেম হোসেন তারা,  ফ্রান্সের প্যারিস থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Jan 2017, 08:47 AM
Updated : 4 Jan 2017, 08:47 AM

প্রয়োজন ছাড়া মানুষ খুব একটা বের হচ্ছে না। কাজ আর বাসার মধ্যে জীবনযাপন আটকে গেছে। যদিও বাস, ট্রাম, মেট্রো বা দূরপাল্লার ট্রেনগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর গন্তব্যপথে যাত্রা করছে। নগরজীবনের ব্যস্ততা যেন ঠাণ্ডার কাছে থিতিয়ে যাচ্ছে।

এই শীতে গাছগুলো তার ডালে পরম মমতায় আগলিয়ে রাখা পাতাগুলো ছুঁড়ে ফেলে উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালতে চলছে বড়দিন আর নববর্ষের ছুটি।  এ সময়ে বরফ ঠাণ্ডা আবহাওয়ার চেয়ে ঘরে বসে হিটারের তাপে শরীর গরম করে দিন পার করছি!

কিন্তু সারাদিন ঘরে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে বাঁচতে প্রকৃতির আলো-বাতাস গায়ে মাখার পরিকল্পনা করছি, আর তখনই হাসিব ভাই ফোন করলেন। জানালেন, লাকুরনভ চলে আসতে।  সেখান থেকে একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে বের হওয়া যাবে। কিন্তু আমার আরেকটি কাজ থাকায় জানালাম, আমি কাজ সেরে সেখান থেকে সোজা রওয়ানা হয়ে যাবো।

সিদ্ধান্ত হলো যে বিকাল ৪টা নাগাদ প্যারিসের সবচেয়ে বড় মেলা ‘নোয়েল লা ভেগাস’ দেখতে যাবো। হাসিব ভাই বললেন,  আমি যেন সুবিধাজনক স্থান সমপোলজি বা বাঙালিদের কাছে প্রচলিত নাম সঞ্জোলজি উপস্থিত থাকি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে সেখানে গিয়ে দেখি তিনি আসেননি।

ফোন করে শুনলাম, মেট্রোতে আছেন এবং মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে যাবেন। প্রায় আড়াই কিলোমিটারের বেশি জায়গা নিয়ে হাইওয়ে রাস্তার দুইধারে বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকানঘর। ‘নোয়েল লা ভেগাস’ মেলা শুরু হয়েছে, বিখ্যাত প্যারিস গেইট থেকে শুরু করে কনকর্ড পর্যস্ত বিস্তৃত।

মেলা চলবে ৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। হাসিব ভাই আসার পর তাকে দিয়ে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলিয়ে নিলাম, কারণ ততক্ষণ বেলা ডুবতে শুরু করেছে। চারপাশে বাতি জ্বালানোহচ্ছে। মেলায় দোকানপাটে সাজিয়ে রাখা আছে বিভিন্ন রকমের খেলনাপাতি, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ঘরের সাজ-সরঞ্জাম।

আর অবশ্যই ভোজনরসিকদের জন্য জগৎ-বিখ্যাত সব ফরাসি খাবারদাবার ও গরমগরম মদ, ওয়াইন কিংবা বিয়ারের ছোটছোট ছাউনি!

ছুটির দিন রোববার হওয়ায় মেলায় উপচে পড়া দর্শনার্থী ও ক্রেতা। ভিড়ঠেলে সামনের ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা রীতিমতো সংগ্রামের। আমরা গল্প করছি আর মেলার সৌন্দর্য দেখছি,  দোকান থেকে মানুষজনের উপচে পড়া ভিড় নিয়ে হাসিঠাট্টা করছি।

সকাল বা সন্ধ্যায় ঢাকার গার্মেন্টসগুলো ছুটি দিলে ছোট গেট দিয়ে শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার তাগিদে এলোমেলো ছুটোছুটির মতো অবস্থা।  কে কার আগে বাড়ি যাবে তার প্রতিযোগিতা চলছে। তবে, এখানকার মানুষের সুশৃঙ্খল হেঁটে চলায় খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।  কেউ একজনকে ধাক্কা দিয়ে আগে বাসে চেপে বসার চেষ্টা নেই। এখানে ধাক্কা মেরে গাড়ি ধরার চেয়ে বলবে, মসিও/ম্যাডাম আলিজি অর্থাৎ জনাব/জনাবা আপনি আগে যান।

আমরা হাঁটছি আর একেকটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরের সুসজ্জিত মালামাল দেখছি। আমাদের উদ্দেশ্য ঘোরাঘুরি করে আনন্দ নিয়ে নিজেদের সতেজ করে ঘরে ফেরা!

হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় গিয়ে অন্যরকম একটা গন্ধের মাদকতা আবিষ্কার করলাম।  হাসিব ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এরকম উৎকট গন্ধ বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের আখমাড়াইয়ের কল কিংবা রস জ্বাল দেওয়ার সময়ে আসে। কিন্তু এখানে তা কোথা থেকে আসছে?

তিনি আমাকে কাছে ডেকে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ওখানকার ওই দোকানটায় গরম ওয়াইন,ভদকা ও বিয়ার বিক্রি হচ্ছে। তাই গরম বাষ্প থেকে এরকম উৎকট  গন্ধ আসছে। আমি গন্ধটা আরও ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য এক্কেবারে যেখানটায় গরম বাষ্প বের হয় তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

গন্ধটা আমাকে গ্রামের আখমাড়াইয়ের সেই শৈশবের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমি কয়েক মিনিট দমবন্ধ করার মতো দাঁড়িয়ে গন্ধটা শুকতে থাকলাম। হঠাৎ, হাসিব ভাইয়ের চেঁচামেচিতে হুঁশ ফিরলো। তার দিকে গেলে তিনি আমাকে বললেন, এভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে মানুষজনের গরম ওয়াইন গেলা দেখলে পাবলিক কী ভাববে?

আমি তাকে কি করে বোঝাই, একটা গ্রামীণ পরিবেশে শৈশব কাটানো দস্যি ছেলের ভালো লাগাটা তিনি কীভাবে বুঝবেন!

পরিবেশ হালকা করতে আমাদের মফস্বলের সেই বিখ্যাত 'গড়ইটুপি'র মেলার কথা শুরু করলাম। 'গড়ইটুপি' হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়মেলা, চুয়াডাঙ্গা জেলায় হয়। ছোটবেলায় চাচাতো বা বয়সে বড় কারো হাত ধরে মেলায় ছুটোছুটি করে ছোট্ট মাটির ব্যাংক কিনতাম। কিংবা  বিশেষ গাড়ি যা টানলে শব্দ করে করে চলতো, তা কেনার পর কতো আনন্দই না পেতাম!

সেই মেলায় পুতুলনাচ, যাত্রাপালা, সার্কাসের জারিজুরি বা ভ্যারাইটি শো এর নামে উদ্দামনৃত্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা হাঁটি।  হাতে তৈরি শো-পিসের একটা দোকানের সামনে আসলে কয়েকটি দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা দেখে চোখ আটকে গেলো। আমরা সেখানে ছুটে গেলাম।

বিজয়ের মাসে প্যারিসের মেলায় বাংলাদেশের এত বড় পতাকা দেশপ্রেম জেগে ওঠে। আমরা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত দোকানি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলাম, তার দেশ কোথায়? বাংলাদেশের পতাকা কতো ইউরো দাম পড়বে?

সে আমাদের অবাক করে দিয়ে জানালো, সে উগান্ডা থেকে এসেছে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে। সে আরও জানালো, বাংলাদেশের মানুষজন খুব ভাল এবং সহৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসেন। মহিলাটি আরও বললো, এটা একটা অ্যাসোসিয়েশনের দোকান আর এসব জিনিসপত্র তার সদস্যরা বাড়িতে তৈরি করেন। দোকানে যেসব দেশের নাগরিকের তৈরি পণ্য আছে তাদের দেশের সম্মানে সেই পতাকাগুলোরাখা হয়েছে।

বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বদেশের পতাকা আর দেশের মানুষের প্রশংসা শুনলে মনে আলোড়ন আসে, প্রতিটি প্রবাসী তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন!

কিছুক্ষণ পর, হাসিব ভাই তার একজন পরিচিত মানুষের সঙ্গে অন্যদিকে গেলেন। আমি একাকি মেলা দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগোলে এক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে দেখা, কলকাতা থেকে এসেছেন। বছর পাঁচেকের একটা মেয়ে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী মেলায় বেড়াতে এসেছেন। তাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। জানতে পারলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সঙ্গে একটা বাংলাদেশি মেয়ে ও তার ফরাসি জামাই মেলায় আসবেন।

আমি যেহেতু মাঝেমধ্যে একটু লেখালেখি করি, তাই তাদের দেখা ও পরিচিত হওয়ার জন্য পরিবারটির সঙ্গে অপেক্ষা করলাম। একটু পরে ফিলিপ ও তার বাঙালিবধূ এলে তাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম, কয়েকটা গ্রুপ ছবি তুললাম। কিন্তু পরিবারটির নিষেধ থাকায় এখানে ছবি দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত। পরিচয়পর্ব শেষে মেলা থেকে হটডগ ও শুকোলা বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলাম।

ফিলিপ মুসলিম মেয়ে বিয়ে করার জন্য মুসলমান হয়েছেন বলে জানালেন। কথায় কথায় ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলছিলেন। তার সঙ্গে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করলাম। সে ২০১৩ সালে একবার বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে অবরোধে পড়েছিল জানালো।

আমি ফিলিপকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ও সুন্দরবন সম্পর্কে জানালাম।  সে সেসব জায়গা ঘুরে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো। চমৎকার মনের একজন ফরাসি কিন্তু বাংলাদেশি জামাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভাল লাগলো।

সুন্দর একটা সন্ধ্যা পার করে ব্যক্তিগত ভালোলাগা নিয়ে মেলা থেকে ফিরে বাসার পথে রওয়ানা হলাম। পেছনে পড়ে রইলো অন্যরকম ভালোলাগা একটা সন্ধ্যা।

লেখক: ফ্রান্স অভিবাসী

ইমেইল: m.tara006@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,  আড্ডা,  আনন্দ বেদনার গল্প,  ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ,  রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!