সাপ্পেরোতে শীতকালে তুষারপাত হয় সর্বোচ্চ ২২০-২৩০ ইঞ্চি। মাঝে মাঝে রেকর্ডসহ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি। ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম এশিয়ায় অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিক এবং এর বার্ষিক স্নো ফেস্টিভ্যালের (স্থানীয় ভাষায় Yuki Matsuri)জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাপ্পেরো।
'সাপ্পোরো স্নো ফেস্টিভ্যাল' উপলক্ষে সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর দুই মিলিয়নেরও বেশি পর্যটক সাপ্পোরোতে ভ্রমণ করতে আসেন। সাপ্পোরোর পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে আছে 'মারুইয়ামা' ও 'মোইওয়া' নামে সুউচ্চ পর্বতমালা। ইসিকারি,তোয়োহিরা এবং সোসিই সাপ্পোরোর উল্লেখযোগ্য নদী।
বছরের অর্ধেকটা সময়জুড়ে স্নো ও সাপ্পোরো যেন একে অপরের পরিপূরক। সাপ্পোরোবাসীরা স্নো'কে কখনও অভিশাপ মনে করেন না, বরং বেশিমাত্রায় উপভোগ করেন। পুরো নগরটাকে শীতকালে স্নো উপলক্ষে ঢেলে সাজানো হয়। স্নোকে ঘিরে চলে বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও অনুষ্ঠান।
শহরের সরকারি ও ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবর্ধক গাছগুলোকে স্নো-এর কবল থেকে রক্ষা করার জন্য সুন্দর করে কাঠের মাচা দিয়ে ঢেকে সাজানো হয়। প্রকৃতির গাছগুলোও যেন স্নোকে বরণ করে নেওয়ার জন্য নিজের সব পাতাগুলোকে ফেলে দিয়ে অধীর আগ্রহে বসে থাকে। প্রতিটি গাছ যেন এক একটা ‘স্নো ট্রি’।
অধিকাংশ জাপানি, এমনকি ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধরাও তীব্র তুষারপাতের মধ্যে যেভাবে হালকা পোশাকে চলাফেরা করেন- তা সত্যিই অবাক হওয়ার মতো! ছোট ছোট শিশুগুলো বরফের ওপর খেলছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে। দেখলে মনে হবে, স্নো যেন তাদের অফুরন্ত আনন্দের উৎস।
এই বরফের মধ্যে হাঁটা ও চলাফেরা মজার, তবে মাঝে মাঝে তা খুবই বিপদজ্জনক হয়ে ওঠে। কারণ বরফ এত পিচ্ছিল হয়ে যায় যে প্রায়ই পড়ে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সাপ্পোরোর এই স্নোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর এখানে আন্তর্জাতিক মানের স্নো ফেস্টিভাল আয়োজন করা হয়। সেখানে বরফ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকৃতি তৈরি করে জাপানি সংস্কৃতির বাস্তব প্রতিচ্ছবিকে ফুটিয়ে তোলা হয়।
স্নোতে স্কি (SKI)এদের অন্যতম একটি জনপ্রিয় খেলা। যার জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে বিশেষ ধরনের 'স্কি ফিল্ড'। সব মিলে স্লো যেন সাপ্পোরোবাসীর নিত্যসঙ্গী।
এই তুষার আবৃত শহরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ- হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়। বলা চলে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এই শহরের প্রাণ। এই শহরের সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয় জাপান তথা বিশ্বের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যত সংখ্যক শিক্ষার্থী এই হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন, তাদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ও প্রতিনিধিত্বশীল শিক্ষার্থীরা আসেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে। ছাত্র-ছাত্রী তথা গবেষক সংখ্যায় ও সুনামে এখানে বাংলাদেশিদের অবস্থান গর্ব করে বলার মত।
বিজ্ঞান, পরিবেশ, চিকিৎসা ও প্রকৌশল মিলে এখানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তথা গবেষক সংখ্যা প্রায় ৪০ জনেরও বেশি। এদের অনেকেই এখানে গবেষণায় মেধা, শ্রম কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন। মূলত তাদের সফলতা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বাংলাদেশিদের অধ্যয়নের সুযোগ করে দিচ্ছে।
প্রতি বছর নতুন করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আসছেন। নবাগত ও বর্তমান শিক্ষার্থী, গবেষক ও তাদের পরিবার-পরিজন মিলে মনে হবে পুরো সাপ্পোরই একটা 'মিনি বাংলাদেশ'। সাপ্পোরোতে বর্তমানে দুইশ'র বেশি বাংলাদেশির বসবাস।
বাংলাদেশিদের নিজেদের ভেতরেও আছে আলাদা একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান উপলক্ষে সবাই একসাথে মিলিত হন। একে অপরের বিপদে-আপদে সাহায্য-সহযোগিতায় সর্বদাই আন্তরিক তারা। এই একাত্ত্বতার কারণে গড়ে উঠছে ‘Bangladeshi Citizen in Sapporo’ নামে একটি সংগঠন।
সংগঠনের ব্যানারে প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও আচার-অনুষ্ঠানগুলো পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে বাঙালি ঘরানার রান্না-বান্না, দেশিয় নাচ-গান মিলিয়ে বেশ দারুণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশি রান্না এখানে বিভিন্ন ফোরামে বেশ সমাদৃত।
ঘোরাঘুরি, আড্ডা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতায় আমাদের অবস্থান খুবই দৃঢ়। মাঝে মাঝে ভুলেই যাই যে আমরা সাপ্পোরোর জাপানি সংস্কৃতির মধ্যে আছি। আমাদের সাফল্য ও সহযোগিতার এই ধারা অব্যাহত থাকুক- এই প্রত্যাশা ও প্রচেষ্টা আমাদের সবার।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা সাপ্পোরোর বাংলাদেশিরাও যেন তার গর্বিত অংশীদার হতে পারি- সেই আশা রাখি।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এবং গবেষক,হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়,সাপ্পোরো, জাপান।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |