ড্যানিশ নিঃসঙ্গতা, কুকুরের মালকিন ও দেশের গল্প

গত পাঁচ বছর যাবত ডেনমার্কে বাস করছি। প্রায়ই যেতে হয় এখানকার দ্বিতীয় বড় শহর আহুসে।

সেলিম সারোয়ার, ডেনমার্ক থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2016, 11:58 AM
Updated : 24 Dec 2016, 12:26 PM

প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার দূরে আহুস শহর। রিজিওনাল ট্রেনে যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। ভাড়া তিনশ’ ক্রোনার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তেত্রিশ শত টাকার মতো। দেশের তুলনায় একটু না, বেশ বেশি।

জীবন মানের হিসেবে সবচেয়ে খরুচে শহরগুলোর সাথে পিছিয়ে নেই কোপেনহেগেন। হংকং, টোকিওর মতোই ব্যয়বহুল। উইকএন্ডে ট্রেনগুলোতে মোটামুটি যাত্রী হয়। আর বাকি দিনগুলোতে অনেকটাই ফাঁকা থাকে।

বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ আয়তনের ছোটো একটা দেশ ডেনমার্ক। জনসংখ্যা মাত্র পঞ্চান্ন লক্ষ। মানুষের চেয়ে গবাদি পশুর সংখ্যা অনেক গুণ বেশি হবে।

চল্লিশ সিটের এক কম্পার্টমেন্টে একমাত্র যাত্রী আমি। দেশে বাসে-ট্রেনে এতো গাদাগাদি করে চলেছি যে, ফাঁকা ট্রেনে চড়তে কেমন যেন উসখুস লাগে। একটা নাই-নাই ভাব।

পথিমধ্যে মুখ থ্যাবড়া বিশাল এক কুকুর নিয়ে ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা ট্রেনে উঠলেন। সোজা এসে আমার সামনের সিটে বসলেন। ঠোঁটে প্রথাগত হাসিটা ঝুলিয়ে ‘হাই’ বললাম। মহিলা হাসিমাখা মুখে প্রতিউত্তর দিলেন। এদিকে কুকুর মহোদয় উৎসুক নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আদর পাওয়ার আশায়।

এদেশে পোষা প্রাণির প্রতি বিরক্তি বা ভয়ের ভাব দেখালে এরা খুব কষ্ট পায়। পোষা প্রাণিকে এরা সন্তানতুল্য স্নেহ করে। ভদ্রতার খাতিরে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতেই ও আরও কাছে ঘেঁষে আসে। গলার নিচটা হাত বুলিয়ে দিতেই পারলে আমার কোলে উঠে বসে।

এবার মহিলা গলায় বাঁধা বেল্টটা টেনে ধরেন, অনুচ্চ কিন্তু কঠোর স্বরে একটা ধমক দিতেই মালকিনের পায়ের কাছে লক্ষ্মী হয়ে বসে পড়ে। অভিমানী দৃষ্টিতে বার বার মালকিনের দিকে তাকায়। প্রত্যুত্তরে মালকিন কুকুরের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ইন্টারনেট

বোবা প্রাণির এই অভিব্যক্তি দেখে আমি তাজ্জব হয়ে যাই!একটা কুকুর নাকি তিন বছরের শিশুর মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে।

“তুমি কিছু মনে করনি তো?” আমি আশেপাশে তাকাই। নাহ, আমি ছাড়া তো কেউ নেই। অবাক ভাবটা লুকিয়ে রেখে উত্তর দিলাম,“কেন?”

“নাহ, মানে এই যে তোমার এখানে বসলাম”,মহিলা বললেন।

“তুমি যেখানে খুশি বসতে পারো, এগুলো সংরক্ষিত নয়”, আমি বললাম।

“ধন্যবাদ তোমাকে”, মহিলা বললেন।

আলাপচারিতার শুরু এভাবেই। “কদ্দুর যাবে?” গন্তব্য বললাম।

“আমি সামনেই নেমে পড়বো”, নিজ থেকেই বললেন মহিলা।“কোথা থেকে এসেছ তুমি?”

“বাংলাদেশ”, আমি বললাম।

কথা প্রসঙ্গে মহিলা যা বললেন, তার সারমর্ম হল- সে ইদানিং রিটায়ারমেন্টে গিয়েছে। আরও ক’বছর চাকরি করতে পারতেন। শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে কিছুটা আগেই অবসরে চলে গিয়েছেন। কুকুরটা ছাড়া আর কেউ নেই তার।

তার রেসিডেন্সের আশপাশের কয়েকটা জোনের মাসিক টিকিট কাটা আছে তার। প্রায়ই ট্রেনে চড়ে বসেন। আমাদের মতো ইমিগ্রান্টস বিশেষ করে এশিয়ান দেখলে যেচে পড়ে আলাপ করেন। স্বদেশিরা খুব বেশি আন্তরিক নয় আলাপচারিতা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ইন্টারনেট

উনি যে এলাকায় থাকেন,সেখানে আশেপাশে খুব কম বসতি। আমি ভাবি,এক কাপ চা সাথে কয়েকটা টোস্ট-সিঙ্গারা হলেই বাঙ্গালী ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চালিয়ে যেতে পারে। বাসে-ট্রেনে, মাঠে-ঘাটে শুধু আড্ডা আর গল্প।

“কিছুই কি করার নেই তোমার”, আমি বললাম।

“হ্যা,আমি সপ্তাহে তিন দিন রেড ক্রসের সেকেন্ড হ্যান্ড শপে বসি। এটা ভলান্টিয়ার সার্ভিস। ভালোই কেটে যায় সময়টা তখন।”

“আচ্ছা,এই সেকেন্ড হ্যান্ড শপের যে আয় হয়, সে টাকাটা তোমরা কি কাজে লাগাও?” মাঝখানে আমি জানতে চাইলাম।

“এই টাকাটা আফ্রিকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ব্যয় হয়”, মহিলা উত্তরে বললেন।

“খুবই মহৎ কাজ”, আমি বললাম।

এভাবে কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এলো। আমি গুগলের সাহায্য নিয়ে ওকে পৃথিবীর বড় সমুদ্র সৈকত আর ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে ধারণা দিলাম। সুন্দরবনের ছবি দেখে ওর ছোখ ছানাবড়া!

এতো সুন্দর ফরেস্ট পৃথিবীতে আছে বিশ্বাসই হচ্ছিল না তার। একশ’ কিলোমিটার দীর্ঘ স্যান্ডি সি বিচ থাকতে পারে,এটা ওর কল্পনার অতীত। সি বিচ আর সুন্দরবনের ছবিগুলো ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখে।

ডেনমার্কের চারপাশে সমুদ্র, মহা-সমুদ্র। একদিকে বাল্টিক আর একদিকে অ্যাটলান্টিক। কোথাও কোথাও বালি ফেলে কৃত্রিম সি বিচ করা হয়েছে। তাও নামকা ওয়াস্তে। শুধুমাত্র প্রচার আর প্রমোটের অভাবে বিশ্ব দরবারে আমাদের এতো বড় সম্পদ অজানা-অচেনা হয়ে রইলো। শুধুমাত্র একটা স্ট্যাচু ( দি লিটল মারমেইড ) দিয়ে গত একশ’ বছরে লক্ষ লক্ষ পর্যটক আকৃষ্ট করতে পেরেছে ডেনমার্ক।

ছবি কৃতজ্ঞতা: রয়টার্স

বললাম,“তোমরা কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে বাংলাদেশসহ এশিয়া ট্যুরে যেতে পারো। ইউরোপে তুমি কোথায় বেড়াবে বল? ভাষার রকমফের ছাড়া কম-বেশি পুরো ইউরোপ একই রকম। আর অন্যদিকে ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যের এতো ভিন্নতা এশিয়া ছাড়া তুমি আর কোথাও পাবে না। বিশেষ করে ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে।”

মনে হলো মহিলা কল্পনায় অনেক দূর চলে গিয়েছেন।তাকিয়ে দেখি কেমন যেন উদাস নয়নে ট্রেনের বিশাল কাচের জানালা দিয়ে অপস্রিয়মাণ তুষারে ঢাকা শুভ্র প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আছেন।

বিষণ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন,“তুমি কি আমাদের গাইড হতে পারবেন?”

“তা পারবো। তবে তোমাদের সাথে আমার সময় মিলবে কিনা জানিনা। তোমরা নেটে সার্চ করলেই অনেক গাইডেড ট্যুর পেয়ে যাবে। তাদের সাহায্য নিতে পারো”, আমি বললাম।

ইতোমধ্যে তার স্টেশনে ট্রেন পৌঁছে যায়। মহিলা উঠে দাঁড়ান, আমিও সৌজন্যতাবশত উঠে দাঁড়াই। খুব আন্তরিকতার সাথে আমার হাতটি ওর দু’হাতের মাঝে টেনে নেন। অতপর কুকুরটিকে নিয়ে ট্রেনের দরজার দিকে হাঁটা দেন উনি। ওর সুন্দর মুখাবয়বে একটা সূক্ষ্ম বেদনার ছাপ খেলে গেল।

জগতের এ লীলা বোঝা বড় দায়! কেউ জনারণ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে আর কেউ মানুষ খুঁজে ফিরছে! 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!