ওমানের জেবালি নারী ও বুনো ভালোবাসা

ওমানের স্বাধীনতা দিবস ১৮ নভেম্বর। এবার পথেঘাটে দেখা গেছে আংশিক আলোকচ্ছটা। আতশবাজিতেও ছিল না আগের সেই যশ।

মো. ফারুক হোসেন, ওমানের মাস্কাট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2016, 09:24 AM
Updated : 7 Dec 2016, 03:35 PM

গত বছরও দেখেছি পথে পথে আলোর খেলা আর আতশবাজির দুর্দান্ত উপস্থিতি। সেই সাথে সুলতান কাবুসের ছবি আর ওমানের পতাকায় সয়লাব হয়ে গিয়েছিল পুরো ওমান। এবার সেটা চোখে পড়েনি। ওমানের অর্থনৈতিক মন্দা বাতাসের ঝাপ্টা স্বাধীনতা দিবস উদযাপনেও লেগেছে।

১৬৫০ সালে ওমান পর্তুগাল থেকে স্বাধীন হয়। অথচ এ বছরে ৪৬তম 'ন্যাশনাল ডে' পালন হল। আমার হিসাবে হওয়ার কথা ছিল ৩৬৬তম। পরে জানলাম এটা পালন হচ্ছে সুলতান কাবুসের ক্ষমতায় আসার পর থেকে। অর্থাৎ ১৯৭০ সাল থেকে হিসেব কষে ৪৬তম হয়েছে।

১৫০৬ সাল অবধি ওমান স্বাধীন ছিল। ওমানের সমুদ্র উপকূল আর বন্দর সুবিধা পর্তুগিজ বণিকদের নজর কাড়ে। নৌপথে ভারতীয় মশলা ব্যবসার আদর্শ পথ ছিল ওমানের উপকূলীয় বন্দর।

১৫০৭ সালে ওমান পর্তুগিজদের দখলে চলে যায়। আর ওমানের বাণিজ্যপথ পায় নতুন এক মাত্রা, যা পরবর্তীতে ডাচ ও ব্রিটেনেরও নজর কাড়ে। পরে অবশ্য ব্রিটেনের সাথে ওমান চুক্তি করলে পর্তুগিজদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে খর্ব হয়। দেশটি ফিরে পায় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ।

ওমানের সূচনালগ্ন থেকেই মরুভূমির আদিবাসী আর উপকূলের আদিবাসীদের মাঝে কিছু পার্থক্য লক্ষ্যণীয় ছিল। মরুভূমির আদিবাসিদের প্রধান খাদ্য ছিল খেজুর ও উটের দুধ।

অন্যদিকে সমুদ্র উপকূলবাসীর এসব খাবারের পাশাপাশি ছিল সামুদ্রিক মাছ ও বিভিন্ন শাকসবজি। ভারত মহাসাগর ও পার্সিয়ান গালফের সাথে বাণিজ্য শুরু হওয়াতে উপকূলবাসী আর মরুবাসীদের সাথে পার্থক্যের মাত্রাটা বেড়ে যায়।

অন্য সংস্কৃতির সাথে মরুবাসীদের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে উপকূলবাসীদের সাথে বিভিন্ন সংস্কৃতির যোগাযোগ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।

এই মরুবাসীরাই বর্তমানে ওমানে ‘বেদু’ নামে পরিচিত। অনেকে এদের ‘জেবালি’ নামেও ডাকে। 'জেবালি' অর্থ 'পাহাড়'। অধিকাংশ বেদুদের পাহাড়ে অবস্থানের কারণে এই নামকরণ। বর্তমানে জেবালিদের প্রধান জীবিকা উট-ছাগল-ভেড়া ও মেষ পালন। ওমানে আরবী’র পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা হচ্ছে জেবালি।

জেবালিরা অন্য সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণেই হয়ত এদের মাঝে সহনশীলতা কম। অন্যান্য ওমানিদের তুলনায় এরা উগ্র ও বুনো মেজাজের। তবে তা শুধু ওদের আচরণেই। পোশাকে আশাকে এরা বেশ রক্ষণশীল।

জেবালি মহিলারা বোরকার সাথে কিম্ভুত আকারের একটা মুখোশ পরে। যাতে থাকে ঠোঁটের উপরে গোঁফের মত প্লাস্টিকের কাজ আর চোখের উপর আলাদিনের জ্বীনের মত ইয়া মোটা প্লাস্টিকের কাজ। দেখলেই ভয় হয়। এটা বোধ হয় পুরুষরা যাতে আকর্ষিত না হয়- সে জন্যই করা।

শিক্ষা-দীক্ষায়ও জেবালিরা অন্যান্য ওমানিদের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। আদি ও ভৌতিক যাদুমন্ত্রে এদের প্রবল বিশ্বাস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ অনেক ওমানিই মনে করেন জেবালিদের অনেকেরই তন্ত্রমন্ত্র বিদ্যা জানা আছে।

ওমানের কিছু এলাকা আছে যেখানে রাতে ওমানিরা গাড়ি চালাতেও ভয় পায়। কথিত আছে যাদু দিয়ে নাকি অনেককেই এখানে ছাগল বা মেষ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সরকার নাকি শক্ত হাতে এই যাদুকরদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব আলোচনায় আমি আরব্য রজনীর গন্ধ পাই। জানি, বাস্তবতার ছিটে-ফোঁটাও নেই এখানে।

কথিত যাদু-মন্ত্র অধ্যুষিত এলাকায় আমি রাত দুটো-তিনটাতেও চলাফেরা করেছি। আঁধার আর নিরবতা ছাড়া কোন অস্বাভাবিকতা আমার চোখে পড়েনি।

বরং ওমানিদের ফেলে আসা প্রাক্তন বাসস্থানগুলোতে গেলে আমার ভিতরে কেমন যেন একটা হাহাকার কাজ করে। পরিত্যক্ত দালান-কোঠায় চোখে পড়ে ওমানের জীবন্ত ইতিহাস। হারিয়ে যাওয়া হাসি-কান্না,  রাগ-অভিমান আর প্রেম-ভালবাসায় মাখামাখি হয়ে আছে যেন পরিত্যক্ত প্রতিটি জানালা-দরজা আর ইটের কণা।

লেখাটা শেষ করছি জেবালিদের নিয়ে কিছু ইতিবাচক কথা বলে। অন্যান্য সংস্কৃতির ছোঁয়ায় ওমান যখন ভারতীয় মুভি ও সিরিয়ালে আক্রান্ত। জেবালিরা কিন্তু সে পথ অনুসরণ করেনি। এখনো তাদের কাছে হিন্দি ভাষা অপরিচিত।

যেখানে ওমানের বর্তমান প্রজন্ম সাবলিলভাবে হিন্দি বলতে ও বুঝতে সক্ষম। তবে বিভিন্ন আরবীয় চ্যানেল বি ফর ইউ,  জি আফলাম, এমবিছি বলিউড প্রভৃতিতে যেভাবে হিন্দি সিনেমা আর নাটকের সিরিয়াল আরবিতে ডাবিং করে দেখানো হচ্ছে, তাতে মরু আদিবাসীরা কতদিন নিজেদের স্বকীয়তা ধরে রাখবে সেটা দেখার বিষয়।

কিছুদিন আগে এক ওমানির (পূর্বপুরুষ উপকূলবাসী) সাথে কথা হচ্ছিল। সে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছিল, জেবালি মেয়েরা স্বামীর খুব যত্ন করেন। এমনকি ভোরবেলায় নাস্তা অব্দি তৈরি করে। ওর বক্তব্যেই বুঝতে পারি, অধুনা ওমানিদের অফিসে যাবার আগে বাসায় নাস্তা জোটে না। নাস্তাটা ওদের রেস্তোরাঁয় সারতে হয়।

জেবালিদের উগ্র বা বুনো যাই বলি না কেন, ওদের জন্যও বুক পকেটে চাপা ভালবাসা নিয়ে পথ চলছে ওমানের বর্তমান প্রজন্ম।।

লেখক: হেড অফ মার্কেটিং(ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত), প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ

ছবি কৃতজ্ঞতা: ইন্টারনেট ও মো. ফারুক হোসেন