সড়ক-দ্বীপে,উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে অতিকায় বাইসাইকেল। মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকি! অসাধারণ একটি ভাস্কর্য!
এমন করে জেদ্দা প্রবাস জীবনের শুরুতে, ছুটির দিনে সিটিবাসে ঘুরতে বেশ আনন্দ হত। কারণ, এক রিয়ালের (সৌদি মুদ্রা) টিকেটে নগরীর এক মাথা থেকে আরেক মাথা। এমনকি সেখানে না নেমে, আবার ফিরে আসায় কোনো বাধা ছিল না।
নিয়ম হচ্ছে যেখান থেকেই উঠি আর যেখানেই নামি, ভাড়া এক রিয়াল। তাই অচেনা এই নগর-ভ্রমণে এমন সুবর্ণ সুযোগ ‘হেলায় নষ্ট করার’, এতটুকু বাঙালি-বুদ্ধির ঘাটতি ছিল না।
হাতে সময় থাকলে কখনো একা, কখনো কোন বন্ধুসহ সিটিবাসে ঘুরে বেড়িয়েছি জেদ্দার এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। সিটিবাসে ঘোরা আরামের ছিল আরো যে সব কারণে তা হল, মার্সিডিস কোম্পানির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক আধুনিক বাস।
দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, বিশ-ত্রিশ মিনিটের বিরতিতে মিলে যায় পরবর্তী বাস।
আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব রাস্তার বাসই ডাউন-টাউন ‘বালাদ’ ছুঁয়ে যায়। তাই যে কোন বাসে চড়ে, শহর ঘুরেফিরে বালাদে ফিরে এসে, নিজ গন্তব্যের বাসে চড়ে ঘরে ফেরা বড় সহজ। তাছাড়া নেই রাত-দিনের বালাই।
শুরুর দিকের এক পড়ন্ত বিকেলে সিটিবাসে ঘুরছি। জানালায় তাকিয়ে দেখি ব্যস্ততম নগরী, ঝকঝকে গাড়ির বহর, সাজানো দোকান-দালান। কতো কী দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি।
জেদ্দা ব্যস্ততম নগরী, তবে কোলাহল কম। গাড়ির হর্নও সীমিত। কেবল গাড়ি চলাচলের যান্ত্রিক শোঁ-শোঁ শব্দ ছাড়া। রাস্তায় পায়ে-চলা মানুষজন তেমন নেই বললে চলে।
নির্জনতা-নিস্তব্ধতার মাঝে একসময় নগরজুড়ে হাজারো মাইকে ধ্বনিত হয়ে উঠে মাগরিবের আজান। বাসের দু'তলায় জানালার পাশে বসে ডুবে আছি আজানের স্বর্গীয় আবেশে। চারপাশ জুড়ে এসময় নিয়নবাতি জ্বলে উঠে কেমন চমকে দিচ্ছে।
রাতে ভিলায় ফিরে সহকর্মী বন্ধুদের কাছে বাইসাইকেল দেখার মুগ্ধতা প্রকাশ করতে, একজন মহাবিজ্ঞের মতো বলে ওঠেন, ‘এটি বাবা আদমের (আ:) বাইসাইকেল।’
আমি হকচকিত, ‘তাই!’ গাম্ভীর্য ছেড়ে পরক্ষণে সবাই হেসে উঠে।
অনেক উপাখ্যান শোনা হয় এই বাইসাইকেল বিষয়ে। সাধারণ দর্শনার্থী ছাড়াও হাজিদের অনেকে ছুটে আসেন বাবা-আদমের (আ:) বাইসাইকেল দেখে চোখ জুড়াতে।
অনেকে না-কি দোয়া-দরুদ পড়েন, দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরেন পরম ভক্তি ভরে।
অতিকায় এই বাইসাইকেল নিয়ে এমনি নানা গল্প-গাথা রয়েছে জেদ্দায়। বাবা-আদমের (আ:) বাইসাইকেল হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি এটির।
একবার ভাবুন, মহানগরীর ব্যস্ততম সড়ক-দ্বীপে, উঁচু বেদিতে ঠায় দাঁড়িয়ে অতিকায় একটি বাইসাইকেল! তিনতলা দালানের সমান উঁচু বাইসাইকেল দেখে পথচারী-দর্শনার্থীর আক্কেল গুড়ুম!
সড়ক-দ্বীপে স্থাপিত বাইসাইকেলটি রোদ-বৃষ্টি-ধুলিঝড় সইছে বছরের পর বছর। মরচে ধরা বিশাল এই বাইসাইকেলটি কত কালের পুরনো! মনে আকুলতা, অতি পুরনো এই বাইসাইকেল নিশ্চয় ছিল কোন বিশালদেহী মানবের! কে সেই মানব!
এমনি নানা ভাবনার মুহূর্তে কেউ হয়তো বলে বসেন, বাবা-আদমের (আ:) নয় তো! তিনিই ছিলেন বিশালদেহী মানব। তিনতলা দালান সমান উঁচু বাইসাইকেল তিনি ছাড়া আর কে চালাবেন ইহজগতে!
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সাধারণ মানুষের মনে, এটি বাবা আদমের (আ:) ছাড়া আর কার! এমনই রহস্যময় কানাকানি থেকে জানাজানি, সেই থেকে বাবা আদমের (আ:) বাইসাইকেল হিসেবে তার পরিচিতি!
এমন একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত নিদর্শনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবেগতাড়িত না হয়ে পারেন না পথচারী।
বিশাল এই বাইসাইকেলটি মূলত একটি লোহার তৈরি ভাস্কর্য।
তেল-অর্থনীতির রমরমা যুগে এটি নির্মিত, স্থাপিত হয়েছে জেদ্দা মহানগরীর ব্যস্ততম কিং ফাহাদ স্ট্রিট ও রওদা স্ট্রিট এর সংযোগ সড়ক-দ্বীপে।
স্থানটির নামকরণ হয়েছে ‘মিদান-আদ্দারাজাহ্’ বা বাইসাইকেল চত্বর। এটি উচ্চতায় ১৫ মিটার আর দৈর্ঘ্যে ২৫ মিটার। দৈত্যাকার বাইসাইকেলটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাইসাইকেল ভাস্কর্য হিসেবে গিনেসবুকে স্থান করে নিয়েছে। যান্ত্রিক সভ্যতার সূচনালগ্নকে স্মরণ করিয়ে দেয় এই অতিকায় বাইসাইকেল।
বছর দুই আগে এই সড়ক-দ্বীপের উপর দিয়ে উড়ালসেতু নির্মাণের পরিকল্পনা হয়। নগরবাসী তখন হায় হায় করে উঠে, বাইসাইকেলের কী হবে! বিস্তর লেখালেখি হয় পত্রিকায়।
অবশেষে নগর কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেন, বাইসাইকেলটি স্বস্থানে বহাল থাকবে। তারা কথা রেখেছেন, সমান্তরাল দুইটি উড়ালসেতুর মাঝখানে বাইসাইকেলটি নতুন আঙ্গিকে স্থাপিত হয়েছে।
তবে স্বস্থানে হলেও, স্বমহিমায় পূর্বের সেই ‘উন্নত শির’ নিয়ে দাঁড়ানোর গর্ব- খর্ব হয়েছে বহুলাংশে। পুরনো ছবি আর বর্তমান ছবিই এর সাক্ষ্য দিচ্ছে। তবুও নিষ্প্রাণ বাইসাইকেলটি প্রাণে বেঁচে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে, এটাই স্বস্তি জেদ্দা নগরবাসীর।
লেখক : প্রবাসী শিশু সাহিত্যিক