ঋতু বৈচিত্র্যহীন দেশ মালয়েশিয়া

মধ্যরাতে এক ঘণ্টার ঝুম বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেল পৃথিবীর এই প্রান্তটা। ঠিক যেখানে আমি থাকি। বৃষ্টির পর এখন সব ভেজাভেজা- রেল লাইন, মহাসড়ক, ঝাড়-জঙ্গল।

রফিক আহমদ খান, মালয়েশিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2016, 01:36 PM
Updated : 9 Nov 2016, 01:36 PM

রাস্তার সোডিয়াম লাইটগুলোর কভারটা ভেজা হলেও লাইটের অন্তর ভেজেনি, মুখটা ভেজেনি। যে মুখ দিয়ে আলো ছড়াচ্ছে রাত গভীরেও ব্যস্ত গাড়িগুলোর জন্যে। ঝিঁঝিপোকারা তো সেই বিকেলে হয়ে যাওয়া ঘণ্টা খানেকের বৃষ্টির পর থেকে ডাকছে তো ডাকছেই। থামে না। থামবেও না আর ভোরের সোনালী সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত।

কোমল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে রাতের উদোম শরীর। হালকা শীত অনুভূত হচ্ছে শীতকালহীন এই মালয় দেশে। ঠিক হেমন্তের শিশির ভেজা রাতের মত।

নিঝুম এই রাতে আরও একবার প্রকৃতির কথা মনে পড়ছে। প্রবাস থেকে দেশে গেলে গ্রামের প্রকৃতির বিশ বছর আগের সেই দৃশ্য আর মেলে না। বর্তমানে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশ বছর আগের দৃশ্য। যে দৃশ্যের কথা কখনো কাউকে বলা হয়নি, কখনো রিপ্লে করে দেখা হয়নি যে দৃশ্য, সেটাই আজ দেখছি দূরের দেশ থেকে।

সেই শৈশবের কথা। হয়ত এ রকম হেমন্তকালে মরিচ ক্ষেত বা সবজি ক্ষেত করার জন্য শুকনো জমিতে চাষ দিতো চাষীরা।

প্রথম দিন মাত্র একবার চাষ দিয়ে মাটি আলগা করে দিত। মাটি আলগা করলেই তরতর করে শত শত কেঁচো বেরিয়ে আসতো। আর কেঁচো খাওয়ার জন্য দলে দলে কত জাতের পাখি আসত! সবচেয়ে বেশি আসত ময়নাপাখি ও চড়ুইপাখিরা। পুরো জমিতে পাখিরা লাফিয়ে বেড়াত আর পেট ভরে কেঁচো খেত।

নব্বই দশকের এ দৃশ্য একুশ শতকে এসে আর দেখি না বললেই চলে। সেই সময়ের জৈব সার নির্ভর চাষীরা ঘরে ঘরে গবাদি পশু পালন করত। এখন রাসায়নিক সার নির্ভর চাষীরা আগের মত জৈব সার ব্যবহার করে না। রাসায়নিক সারের বিষক্রিয়ায় জমিতে নেই কেঁচো, খাদ্যহীন জমিতে পাখিরাও দল বেঁধে আসে না।

বর্ষাকালে টানা দু-তিন মাস আমাদের পাহাড়ি জমিতে পানি জমে থাকতো। বর্ষা শেষে শরৎ, হেমন্তে পাহাড়ি জমি থেকেও মাছ ধরতাম আমরা। এখন পাহাড়ি জমিতে মাছ পাওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না। যেখানে বাড়ির পাশের ধানী জমিতেই আগের মত মাছ পাওয়া যায় না, সেখানে আবার পাহাড়ের জমিতে মাছ! শুধুই স্মৃতি।

এখন মাছ মানেই পুকুরে চাষ করা মাছ। এই মাছের উৎপাদন বেশি, স্বাদ কম।

যাক, চলুন এবার এক লাফে গ্রাম থেকে মালয়েশিয়ায় আসি। মালয়েশিয়ায় শরৎ, হেমন্ত, শীত- এরকম কোন ঋতু নেই। এ দেশের অনেক মানুষকে আমি ঋতুর কথা জিজ্ঞেস করেছি। মালয়েশিয়ায় কয় ঋতু বা নাম কী কী ইত্যাদি। কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারে না। তখন মনে পড়ে শৈশবের পড়ালেখার কথা।

আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে এ রকম কোন বাঙালি নেই যিনি ষড়ঋতুর কথা জানে না। রূপসীবাংলার ষড়ঋতুর রূপের গল্প সবারই জানা। ছোটবেলায় বইয়ে পড়া 'ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ- বাংলাদেশ' কথার মর্মকথা বুঝি এখন, ঋতু বৈচিত্রহীন দেশ মালয়েশিয়ায় দীর্ঘ প্রবাস জীবন যাপন করে। মালয়েশিয়ায় চোখে পড়ার মত তেমন ঋতুবৈচিত্র্য নেই।

ঋতুবৈচিত্র্য খু্ঁজতে গিয়ে মালয়েশিয়ার প্রকৃতিতে সারা বছর সামান্যই পরিবর্তন দেখেছি। আমাদের বাসার নিচ থেকে হেঁটে ট্রেন স্টেশন যেতে আট মিনিট সময় লাগে। এ পর্যন্ত জায়গায় অসংখ্য সোনালু গাছ আছে। আমাদের বাসার নিচেও অনেক সোনালু গাছ। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সোনালু গাছগুলো ফুলে ফুলে ভর্তি থাকে। ভালো লাগার মতো। কুয়ালালামপুর শুধু বিল্ডিং-এর শহর নয়, গাছের শহরও বটে। সবুজ শহর।

কুয়ালালামপুর শহরে এমন কোন জায়গা যেই যেখানে বড় বড় সোনালু গাছ নেই। অন্যান্য গাছ তো আছেই। এ সময়ে দিনরাত্রি মধুর সুরে কোকিল ডাকে- কুহু...কুহু। আমার এগার তলার বাসায় কোকিলের ডাক শুনেই সকালের ঘুম ভাঙে ফেব্রুয়ারি-মে মাসে। কুয়ালালামপুরের সব জায়গায়ই এ সময়ে মধুর কণ্ঠে কোকিল ডাকে। কোকিলের ডাক শুনলে মনে হয় আমি আমার গ্রামেই আছি।

ঢাকা-চট্টগ্রামে মূল শহরে বসন্তে কোকিলের ডাক শোনা যায় কিনা জানি না। কিন্তু কুয়ালালামপুর শহরের সবখানেই কোকিল ডেকে যায় চিরচেনা সেই মধুর সুরে।

বাংলাদেশে যখন গ্রীষ্মকাল মালয়েশিয়ায়ও তখন একটু তাপমাত্রা বেশি থাকে। বর্ষাকালে বৃষ্টি থাকে বলা যায়। তবে বাংলাদেশের মত টানা তিন-চার দিন বিরতিহীন বৃষ্টি হয় না এখানে। বিরতি দিয়েই বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি এখানে কম-বেশি সারাবছরই হয়। তাই তো মালয়েশিয়ায় যেসব শাক-সবজি বা ফলমূলের চাষ হয়, তা সারাবছরই হয়। খাবারে ঋতুভিত্তিক তেমন বৈচিত্র্য নেই।

হেমন্তে যখন বাংলাদেশে হালকা হালকা শীত অনুভূত হয়, কুয়াশার আগমন ঘটে, ঠিক ওই সময় থেকে মালয়েশিয়ায়ও রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকে। অক্টোবরের মাঝমাঝি সময় থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এ রকম থাকে।

সন্ধ্যায় বা রাতে যদি এক দু-ঘণ্টার ঝুম বৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে রাতের অবশিষ্ট সময়ে সামান্য ঠাণ্ডা লাগে। তবে তা কোন মতেই শীতকাল বলা যাবে না। এটা শুধু একটু আরামে রাতের ঘুম হওয়ার মতো ঠাণ্ডা।

এই দেশে ঠাণ্ডা বা কুয়াশা খুঁজতে গেলে যেতে হবে দুই উঁচুভূমি- গেনতিং ও ক্যামেরুন- এ। এই দুই হাইল্যান্ডে সারা বছরই শীতকাল। সন্ধ্যা থেকে এখানে কুয়াশা নেমে আসে। মেঘ নেমে আসে হাতের ছোঁয়ার নাগালে। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শীতকালের মতো ঠাণ্ডা লাগে। এখানেও একই অবস্থা, বৈচিত্র্য নেই। সারাবছরই ঠাণ্ডা।

এই তো এখন বাংলাদেশে হেমন্তকাল। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে হেমন্ত এসেছে বাংলার প্রকৃতিতে। মালয়েশিয়াতেও এখন রাতের তাপমাত্রা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। রাতের হালকা শীতল আবহাওয়াটা ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে খুবই উপযুক্ত।    

এ লেখা লিখতে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে প্রতিবার টাচ করতে-করতে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে অবিরত। এবার ঘুমানোর পালা। দেশ থেকে আনানো নকশি কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি এখন। সবাইকে শুভেচ্ছা।