বিদেশে এসে গ্রামের কথা মনে পড়ে

বিস্তীর্ণ খোলা আকাশ। রাতের আকাশে চাঁদ। কখনো চাঁদ মেঘে ঢাকা। আমি যে কন্ডোমনিয়ামে থাকি এর পাশেই রেললাইন। রেললাইনের ওপাশে হাইওয়ে। হাইওয়ের টোলপ্লাজাটা বরাবর এখানেই। এখানে টোল হওয়াতে টোলপ্লাজার আগে-পরে রাস্তাটা আরো বেশি প্রশস্ত। এখানে টোলের আগে-পরে স্টেডিয়ামের ফ্লাশলাইটের মতো লাইট আছে। হাইওয়ের এ জায়গাটা রাতের বেলায় স্টেডিয়ামের মতো মনে হয়।

রফিক আহমদ খান, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Oct 2016, 12:31 PM
Updated : 18 Oct 2016, 03:45 PM

গভীর রাতে ঘুমন্ত রেললাইনে টর্চলাইট হাতে দু-একজন পাহারাদারের আনাগোনা। পাশেই মহাসড়কে গাড়িগুলোর সাঁই সাঁই শব্দে ছুটে চলা। বাসার ব্যালকনিটা শহরমুখি না হয়ে শহরের উল্টোমুখি হয়ে ভালই হয়েছে। শহরভিউ হলে উঁচু-উঁচু বিল্ডিংগুলোতেই আটকে যেতো চোখ।

ব্যালকনি থেকে নিচে তাকালেই গাছপালা আর ঝাড়-জঙ্গল। সেখান থেকে বৃষ্টিভেজা রাতে ভেসে আসে ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙের ডাক। গাঁয়ের মাটিতেই জন্মেছি,গায়ে মাটি আর কাদা মেখে বড় হয়েছি। আমার কাছে ঝিঁঝি আর বর্ষার ব্যাঙের ডাক চিরচেনা এক সুর। চিরচেনা সেইসব সুর এ বিদেশ-বিভূঁয়ে শুনতে ভালোই লাগে।

কুয়ালালামপুরে অনেক জায়গায় অনেক বাসায় থাকলেও এ রকম প্রকৃতিঘেষা জায়গা আর পাইনি। তাও আবার মূল শহরের কাছেই। 

প্রতিদিনই বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে মধ্যরাত পেরিয়ে যায়। এরপর তো স্মার্টফোনেই কেটে যায় আরো দুই-আড়াই ঘন্টা। এ সময়টাতেই স্মার্টফোন হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়ালে মুহূর্তেই প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়।

প্রকৃতির কথা মনে পড়লে নিজের শৈশব-কৈশোরের উচ্ছ্বল কথা মনে পড়ে। বঙ্গোপসাগরের উপকূল, আমার প্রিয় এলাকা আনোয়ারা,পাহাড় ঘেরা আমাদের বৈরাগ গ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। শরতের রাতে চাচাদের উঠোনের সামনে ফুটে থাকা বেলিফুল আর গন্ধরাজের মৌ মৌ গন্ধের কথা মনে পড়ে। শৈশবে মসজিদের সামনের গাছ থেকে ঝরে পড়া শিশিরভেজা শিউলি ফুল কুড়ানোর কথা মনে পড়ে,বর্ষার বৃষ্টিতে পাহাড়ের পাদদেশে জমিতে জলখেলার কথা মনে পড়ে,খালে পুলের গোড়ায় পাড়ার বড়দের মাছ ধরার কথা মনে পড়ে।

ভাবতেই অবাক লাগে,আমাদের দেশে নানা ঋতুতে শুধু প্রকৃতির দৃশ্যপটই পাল্টায় না, ঋতুভেদে মাছ-তরকারি, ফলমূল, ফুল,পাখি সবই পাল্টে যায়।

এখন অক্টোবর মাস। আমাদের দেশে এখন ফুলকপি, বাধাকপি, শিম, মূলা এসব সবজি নেই। আবার শীতকাল এলেই এসব সবজির দেখা মিলবে। প্রথম যখন সব শাক-সবজি আসতে শুরু করে, তখন কি যে স্বাদ লাগে!

.

মালয়েশিয়ায় সারা বছর একই শাক-সবজি, একই মাছ। কোনো নতুনত্ব নেই। তাই মালয়েশিয়ানদের বাংলাদেশের কথা বললে ওরা অবাক হয়।

মালয়েশিয়ান ও ইন্দোনেশিয়ানরা আরো অবাক হয় বাংলাদেশে শীতকাল আছে শুনলে। শীতকালের নাম শুনলেই ওরা কুয়াশার কথা জিজ্ঞেস করে। জানতে চায় কুয়াশা কেমন পড়ে? জিজ্ঞেস করার ধরণ দেখে মনে হয় কুয়াশা ওদের খুব পছন্দ।

শীতের কথা বললেই মনে পড়ে শৈশবে দেখা শীতের সকাল। দূর গাঁয়ের চাষীদের কলসি মাথায় খেঁজুরের রস বেচতে আসার সেই দৃশ্য। যদিও এখন আর তেমন দেখা যায় না আমাদের গাঁয়ে। আমার গ্রামের আশেপাশের গ্রামেও খেঁজুর রস নেই আর! দূরের গ্রামে কিছু কিছু আছে।

শিল্পায়ন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। কলকারখানার আগ্রাসনে আমাদের প্রিয় আনোয়ারার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে।

.

কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি'র (কাফকো) কলোনী আর কোরিয়ান ইপিজেড আমাদের পাহাড়েই হয়েছে। পাহাড়ের আরেক অংশে বিমান বাহিনীর রাডার কেন্দ্র হয়েছে সেই পঁচিশ বছর আগে। নতুন করে আমার এলাকার ৭৭৪ একর সবুজ ভূমি উজাড় করে হচ্ছে চীনা অর্থনৈতিক জোন। এই চীনা অর্থনৈতিক জোনে ৩৭১টি দেশি-বিদেশি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার কথা। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিতব্য টানেলটিও গিয়ে উঠবে আমাদের গ্রামে। গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাবার ফলে আমাদের দেয়াং পাহাড়টার ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা এখন।
সমাজের বা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন যেমন প্রয়োজন, তেমনি সুস্থ জীবনের জন্য প্রয়োজন সবুজ প্রকৃতি। তাই শিল্পায়ন করতে গিয়ে সবুজ প্রকৃতি যেনো হারিয়ে না যায়, সে দিকটা খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী।

চট্টগ্রামের সৌন্দর্যই হলো তার পাহাড়,নদী আর সমুদ্র। এখনো রাত গভীর হলে দূর প্রবাসে এই ব্যালকনিতে দাঁড়ালে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার শৈশবের অবিকৃত 'দেয়াং পাহাড়'। চোখের সামনে খেলা করে শৈশবের গাঁয়ের সবুজ প্রকৃতি।

শিল্পায়ন হোক, তবে সবুজ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়।