ব্রেক্সিট: দ্বিধা-শঙ্কার দোলাচলে প্রবাসীরা

যুক্তরাজ্য ইউরোপ থেকে বেরিয়ে গেলে কী হবে, তা নিয়ে ব্রিটেনবাসীদের মতো প্রবাসী, বিশেষ করে বাংলাদেশিরা নানা হিসাব মেলাতে এখন ব্যস্ত।

সৈয়দ নাহাস পাশাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2016, 10:26 AM
Updated : 25 June 2016, 11:14 AM

অভিবাসনবিরোধী হিসেবে পরিচিতি ‘লিভ’ সমর্থকদের এ বিজয় যুক্তরাজ্য থেকে ‘বিতাড়িত’ করার সঙ্কেত কী না তা নিয়ে আশঙ্কা যেমর আছে, উল্টো দিকে ইউরোপীয় অভিবাসী কমলে বেড়ে যাবে দক্ষিণ এশিয় প্রবাসীর সংখ্যা- এমন আশার স্বপ্নও আছে।

বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে ইইউ-তে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৫২ শতাংশ ব্রিটিশ ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে এবং ৪৮ শতাংশ মানুষ ইইউয়ে থাকার পক্ষে ভোট দেয়।

প্রায় এক দশক ধরে যুক্তরাজ্যে থাকা বাংলাদেশি হাসান আহমেদও ‘বিচ্ছেদে’র পক্ষে রায় দিয়েছেন। তার মতে, ইউরোপের অভিবাসীরা অবাধে যুক্তরাজ্যে এসে সুযোগ-সুবিধায় ‘ভাগ বসায়’ এমন সন্দেহের কারণে স্থানীয়রা ‘বিচ্ছেদ’ এর পক্ষে রায় দিয়েছে।

“পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা অভিবাসীরা বর্ণবাদী। তাদের আচরণ ব্রিটিশদের মত উদার নয়। এজন্য বাঙালিরা তাদের পছন্দ করে না। ব্রেক্সিট বাস্তবায়িত হলে এরা আর যুক্তরাজ্যে আসতে পারবে না, আমাদের চাকরি-বাসস্থানে ভাগ বসাবে না। তাই ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছি,” বলেন হাসান।

অন্যদিকে ইউরোপের অন্য দেশে অভিবাসী হয়ে পরে যুক্তরাজ্যে চাকরি-ব্যবসা করে থিতু হয়েছে এমন প্রবাসীরা আছেন ‘দেশচ্যুত’ হওয়ার আশঙ্কায়।

এমনই একজন ইউরোপীয় পাসপোর্টধারী মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী ইকরাম ফরাজি ইতালিতে অভিবাসী হয়ে পরে যুক্তরাজ্যে আসেন।

ইতালিতে তার ব্যবসার একটি শাখা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আগে দুই দেশেই ভালোভাবে ব্যবসা করা যেত; এখন কি হয় কে জানে? ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি। আদৌ ব্রিটেনে থাকতে পারব কী না, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।”

ইকরাম জানান, গত পাঁচ বছরে কেবল ইতালি আর স্পেন থেকে তার মতো ১০ হাজার বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে এসেছেন, যারা গণভোটের পর বিপাকে পড়েছেন।

যুক্তরাজ্যে ইতালিয়ান বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রেজাউল মনে করেন, গণভোটের এই রায়ের ফলে ইউরোপে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করেন এমন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বে।

“লন্ডনের বাংলাদেশি গ্রোসারি শপের বেশিরভাগ পণ্য যেমন ধনিয়া, শসা, সীম ও শাকসব্জি আসে ইতালি থেকে। এখন ব্যবসাটা এত সহজ হবে না,” বলেন তিনি।

ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ট্যাক্সিচালক মিজানুর রহমানও। ২২ বছর ইতালিতে থাকার পর তিন বছর আগে স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে লন্ডনে আসেন মিজান।

“ওখানে (ইতালিতে) স্বামী-স্ত্রী দুজনই ভালো চাকরি করতাম। আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলাম। এসেছি ছেলেকে ভালো কোথাও পড়াতে। ভোটের পর মনে হচ্ছে ভুল করলাম কী না?”

তবে শঙ্কা থাকলেও ইতালিতে ফিরে যাওয়ার ‘চিন্তা মাথায় আনছেন না’ মিজান।

গণভোটের এই ফল বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্রেক্সিটের কারণে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ‘ঝুঁকিও বাড়ছে’ বলে মন্তব্য করেছেন ব্যাংক এশিয়া মানি এক্সচেঞ্জের সিইও কামরুল হুদা আজাদ।

“পাউন্ডের দরপতনের কারণে কালো টাকার মালিকরা এ সুযোগ নিতে পারে। বৃহস্পতিবার পাউন্ডের দর ছিল ১১৭ টাকা; একদিনে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১০৪ টাকায়। অনেকের আশঙ্কা, কমতে কমতে এটি ৯০-এ ঠেকতে পারে। এ সুযোগে টাকা পাচারের সুযোগ বাড়বে।”

লন্ডনে থাকা আটটি বাংলাদেশি ব্যাংকের মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ও ‘ভাটা পড়বে’ জানিয়ে আজাদ বলেন, যেসব প্রবাসী বাংলাদেশে টাকা পাঠাতেন, তারা টাকা পাঠাতে গিয়ে দেখবেন বাড়তি পাউন্ড গুণতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশে রেমিটেন্সের প্রবাহও কমে যাবে।

ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন আশঙ্কায় যুক্তরাজ্য ছাড়ার কথা ভাবছেন প্রবাসী ব্যবসায়ী ইকবাল আহমেদ ওবিই।

ম্যানচেস্টারভিত্তিক সামুদ্রিক খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সীমার্ক পিএলসির এ চেয়ারম্যান জানান, গণভোটের ফল ইউরোপের মধ্যে অবাধ বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করবে।

“সীমার্কের ৭০ ভাগ ব্যবসাই ছিল ইউরোপের সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে সামুদ্রিক খাবার, মাছ আর চিংড়ি আনার জন্য আমরা এক সার্টিফিকেটেই ২৮টি দেশে পণ্য পাঠাতে পারতাম। যুক্তরাজ্যের বাজারে মোট রপ্তানির ৩০ ভাগ যেত, একে কেন্দ্র করে বাকি পণ্য অন্য দেশগুলোতে পাঠানো হতো। এখন হয় যুক্তরাজ্যে ব্যবসা করতে হবে, না হলে এখান থেকে শিফট হতে হবে।”

ব্রেক্সিটের কারণে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বেশি কর দিতে হবে বলে জানান বাংলাদেশের এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইকবাল।

তার মতে, ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসাকে ‘ওয়ান স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড’।

তবে এ অস্থিরতা বেশিদিন থাকবে না বলে আশাবাদী যুক্তরাজ্যভিত্তিক কনজারভেটিব ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের মেহফুজ আহমদ।

“ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে যে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি বিপাক পড়বে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা আগেই সতর্ক করেছিলেন, হচ্ছেও তাই। তবে দ্রুত এ অবস্থা কেটে যাওয়া দরকার।”

ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিলেও ‘রায়’ মেনে নিয়েছেন তিনি। আশা করছেন, দ্রুত সংকট কেটে যাবে; পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

“দেশের (যুক্তরাজ্য) মানুষ যেহেতু এক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে, তাই উচিত হবে দ্রুত জোট থেকে বেরিয়ে আসা। যত দ্রুত এক্সিট সম্পন্ন করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, ততই মঙ্গল।”