‘চুরি’তে আপত্তি জাপানিদের

এদেশে চুরি শব্দটি যেন এড়িয়ে যেতে চায় সবাই!  

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপানের ওসাকা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2015, 02:20 PM
Updated : 20 August 2015, 04:10 PM

জাপানের শতকরা প্রায়  ৮০ ভাগ লোকের গাড়ি আছে। আর শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ লোকের বাইসাইকেল আছে। গাড়ি থাকার পরও জাপানিদের বাইসাইকেলের প্রতি ভালবাসা বেশ চোখে লাগার মত।বাইসাইকেল ছাড়া এক মুহুর্ত যেন চলতে পারে না এরা! তাই জাপানে ওসাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়তে আসার কয়েক দিনের মধ্যে আমিও একটি বাইসাইকেল কিনি।

সাইকেলটি নিয়েই প্রতিদিন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করি। ডিসেম্বরে নতুন হোস্টেলে ওঠার পর থেকে সাইকেলটি নিচতলার গ্যারেজেই রাখতাম। গ্যারেজটি প্রধান সড়কের পাশেই হওয়ার পরও কখনও সাইকেলে তালা লাগাইনি। কারণ, আমার জাপানি গবেষণা সহকর্মীরা ও ওসাকায় বসবাসরত বাঙালিরা বলতেন ‘জাপানে কোন জিনিস চুরি হয় না, এখানে রাস্তায় জিনিস পড়ে থাকলেও আপনার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে!’

ভালোই চলছিল। কিন্তু জুন মাসের একদিন রাত ১১ টায় গবেষণাগার থেকে ফিরে সাইকেলটি গ্যারেজে রাখার পরের দিন সকালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই দেখলাম আমার সাইকেলটি নেই!

আশেপাশে খুঁজেও সাইকেলটি পেলাম না। আর তাই উপায় না দেখে পায়ে হেঁটেই গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। কাজ শেষে আমার এক সহযোগী অধ্যাপককে সাইকেলটি খুঁজে না পাওয়ার কথা বলতেই তিনি যেন ‘চমকে’ উঠলেন’!উনাকে বললাম আমার সাইকেলটি নিশ্চই কেউ চুরি করেছে। ‘চুরি’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই অধ্যাপকের চোখ মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন স্পষ্ট বোঝা গেল। তিনি কিছুতেই মানতে রাজি হলেন না যে আমার সাইকেলটি চুরি হয়েছে!

ছবির ক্যাপশন: প্রতীকী ছবি/ রয়টার্স  

ঘটনাটি আমার কয়েকজন জাপানি সহ-গবেষককে জানালে তারাও চোখমুখ কেমন জানি কাঁচুমাচু করতে লাগলেন।

আমি বিষয়টি কিছুতেই বুঝেই উঠতে পারলাম না! চুরি শব্দটি শুনে এরা কেন মুখ বাঁকা করছে?

যাই হোক জাপানি ক্লাসমেটদের পরামর্শে আমি পুলিশ ফাঁড়িতে গেলাম অভিযোগ দায়ের করতে।

ফাঁড়িতে পুলিশ বাহিনির এক সদস্যকে জানালাম যে, সকাল থেকে আমার সাইকেলটি পাচ্ছিনা।কেউ আমার সাইকেলটি চুরি করেছে।

এই কথা শোনার পর দেখি এই পুলিশ কর্মকর্তাও কেমন যেন চুপ মেরে গেলেন!ওই কর্মকর্তা আমাকে জানালেন অভিযোগটি দায়ের হল এইভাবে - ‘আপনি সাইকেলটি গ্যারেজে রেখেছিলেন, সেখান থেকে হারিয়ে গেছে’ আমি অবাক হয়ে তাকে বললাম, খুঁজে পাচ্ছি না ঠিক আছে কিন্তু আমার সাইকেলটিতো কেউ না কেউ অবশ্যই চুরি করেছে।  

এবার পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে জানান, সাইকেলটি হারিয়ে গেছে এই মর্মে আমি অভিযোগ করতে রাজি কি না? আমি অবাক হলেও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজি হলাম। অভিযোগের দালিলিক কাজ শেষে আমাকে জানালেন,  সাইকেল  খুঁজে পেলে ফোনে জানানো হবে।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে কখনোই সাইকেলটি ফিরে পাবো না।

তবে ১২ অগাস্ট হঠাৎ করে পুলিশের কাছ থেকে ফোন পেলাম।তারা জানালেন আমার সাইকেলটি পাওয়া গেছে!

সাইকেলটি ওসাকা শহরের কাছেই অন্য একটি সিটি কর্পারেশনের হেফাজতে আছে। পরদিন আমি ফের পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখা করে ফোন পাওয়ার বিষয়টি জানাই। ওরা আমাকে সাইকেলের বর্তমানে অবস্থানের বিস্তারিত ঠিকানা দিয়ে বললো সাইকেলটি হাতে পাওয়ার পর আমি যেন অবশ্যই একবার দেখা করে যাই। কারণ তখনই আমার অভিযোগটির নিষ্পত্তি হবে।

১৪ অগাস্ট সকালে ট্রেনে করে পাশের সিটি কর্পারেশনে গিয়ে দেখি একটি ফ্লাইওভারের নিচে একটি ঘরে আমার সাইকেলটি যত্নে রাখা! কর্তব্যরত ব্যক্তির কাছে জানলাম আমার সাইকেলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনিও বলে দেন   আমি সাইকেলটি নিয়ে যেন ওসাকার পুলিশ স্টেশনে গিয়ে দেখা করি।

আমি সাইকেলটি নিয়ে ফের পুলিশ ফাঁড়িতে যাই। আমার সাইকেলটি কিভাবে, কোথায় ফেরত পেলাম তা বিস্তারিত বলতে বলা হল।

এই পুলিশ কর্মকর্তা যেখানে আমাকে গতকাল সব তথ্য জানালেন তাকে এই ঘটনা আবার বলতে হবে?!

যাই হোক কাগজপত্রে আমার সামনে লেখা হল এভাবে- আমি সাইকেলটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সিটি কর্পোরেশনের হেফাজত থেকে ফিরে পেয়েছি, সুতরাং সাইকেলটি কেউ চুরি করেনি!

সাইকেলটি ফিরে পাওয়ার সময় যেহেতু পুলিশ কাউকে আটক করেনি তাই এই ঘটনাকে চুরি বলা যাবে না! আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল আমি তথ্য সমর্থন করি কিনা। ঝামেলা এড়ানোর জন্য বলে দিলাম, হ্যাঁ আমি রাজি।

ছবির ক্যাপশন: প্রতীকী ছবি/ রয়টার্স  

এরপর আমার স্বাক্ষর নিয়ে ঘটনাটির নিষ্পত্তি করা হল।

আমি পুলিশ কর্মকর্তাকে কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে আমার সাইকেল কেউ চুরি করেনি? কর্মকর্তার কথা  আমার সাইকেলটি উদ্ধার করার সময় কাউকে হাতে নাতে ধরা হয়নি। তাহলে ধরে নিতে হবে সাইকেলটি চুরি হয়নি। কেউ সাইকেলটি ব্যবহার করেছে মাত্র!

আমি ফেরত এসে ভাবতে লাগলাম, এরা চুরি শব্দটিকে ভয় পায় কেন? কেনই বা তারা চুরি হয়নি বলে বারবার দাবি করা হল? কেন আমার গবেষণা সহকর্মীরা চুরি শব্দটি শোনার পর চোখমুখ কাঁচুমাচু করেছিল?

পরে কয়েকজন জাপানির সঙ্গে কথা বলে এক ধরনের উত্তর পেলাম। জাপানিরা চুরি শব্দটিই পছন্দ করে না।চৌর্যবৃত্তিকে  এক ধরনের অপবাদ হিসাবেই দেখে এই জাতি। তাই চুরি শব্দটি এড়িয়ে যেতে চায় এরা।  

আরও জানলাম কালেভদ্রে পুলিশও নাকি ‘চোর’ ধরে প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে লজ্জাবোধ করে। কারণ এরা জাতিগতভাবে  নিজেদেরকে সৎ ভাবতে অভস্থ্য ও পছন্দও করে।

মনে মনে ভাবলাম, আমার সাইকেলটি কেউ হয়তো ‘জরুরী প্রয়োজনে’ ব্যবহার করেছে কিন্তু লাপাত্তা হয়নি। আর পুলিশও আমার সাইকেলটি দেড় মাসের মাথায় ঠিকই খুঁজে বের করেছে।

প্রবাস জীবনের গল্প ও অভিজ্ঞতা এখন থেকে আমাদের সরাসরি জানাতে পারেন। পুরো নাম ও সংশ্লিষ্ট ছবিসহ লেখা পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়  probash@bdnews24.com