‘একাত্তরের সব ঘাতকের বিচার দেখে যেতে চাই’ 

জাপানের অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি এই প্রত্যাশার পাশাপাশি জানিয়েছেন বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতি তার ভালোবাসার কথাও।   

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপানের ওসাকা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2015, 02:48 PM
Updated : 7 Jan 2016, 09:28 AM

জাপানে জন্ম নিলেও বাংলা ভাষার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি। তার কর্মক্ষেত্র জাপান হলেও বাংলা ভাষার কলমযোদ্ধা হিসেবেই পরিচিতিটা বেশি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ২০১৩ সালে বিদেশি বন্ধু সম্মাননায় ভূষিত এই অধ্যাপক সম্প্রতি জাপানের ওসাকা শহরে বাঙ্গালিদের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের সাধারণ মানুষদের বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দিতে ওই সময় জাপানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন তিনি। একই সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় বাংলাদেশকে সহায়তা কারার জন্য অর্থ তহবিলও গড়ে তুলেছিলেন বলে জানান তোমিও মিজোকামি।

অনর্গল বাংলা বলা এই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমি ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধ বিগ্রহকে ঘৃণা করতাম। যেকোন যুদ্ধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নিজের নৈতিক দায়িত্ব বলেই মনে করি।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক চার বছর আগে জন্ম নেওয়া তোমিও মিজোকামি স্কুলজীবন থেকেই বিদেশি ভাষা বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। “সেই ধারায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে আমি নিজে বাংলা ভাষার সমর্থন জানিয়ে আসছিলাম।” বলেন তিনি।

ওসাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ‘বিদেশী ভাষা শিক্ষা’ বিভাগ থেকে ভারতীয় ভাষা বিষয়ে স্নাতক করা এই অধ্যাপক বিশ্বভারতীতে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেন।

তখন থেকেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি বাঙালিদের প্রতি গভীর আগ্রহের শুরু। অধ্যাপক তোমিও মিজোকামি বলেন, “একাত্তরের সময় আমি ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলাম।ওই সময় পত্র-পত্রিকা আর বিশ্বভারতীর কিছু বন্ধুদের কাছ থেকে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানের শোষণ আর নির্যাতনের কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারিনি।”

“বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে আমি জাপানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করি। বাঙালিদের ব্যাপারে ওতটা ধারণা না থাকলেও আমার প্রচারণায় জাপানিদের কাছে বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল।

“আমি জানতাম পাকিস্তানের ওই শোষণ থেকে বাঙালিরা মুক্তি পাবে। পাকিস্তানিদের জুলুম আর অত্যাচার যে তাদের পতনের মূল তা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। আর আমার লেখায় কেবল মানবতার জয়গানই ফুটে উঠেছিল।”

‘বাংলাসংলাপ: বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়’ শীর্ষক বাংলা গ্রন্থের লেখক তোমিও মিজোকামি আরও বলেন, “বাঙলা খুবই সমৃদ্ধ ভাষা। আর এই ভাষার মানুষদের মুক্তির জন্য কিছু করতে পারাকেও আমি দায়িত্ব মনে করছি। একাত্তরের যুদ্ধের সময় আমি আমার বেতনের কিছু অংশ আর অনান্যদের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলাম।”

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা থাকলেও যোগাযোগ বিচ্ছন্নতার কারণে আসতে পারেননি। তবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি নাকি তাকে নতুন করে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছিল, জানান তিনি।

যুদ্বাপরাধীদের বিচারে সোচ্চার এই বিদেশী বন্ধু বলেন, “আমি খুব আনন্দিত যে, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। এই বিচারের মাধ্যমে প্রমাণিত হতে চলছে, মানবতার অবমাননা ক্ষমাযোগ্য নয়। আমি বেঁচে থাকতে দেখতে চাই দেশটির একাত্তরের ঘাতকদের বিচার। যাতে করে বিশ্ববাসী দেখতে পারে যুদ্ধ কখনো শান্তির প্রতীক হতে পারে না।”

এই অধ্যাপক জানান, পৃথিবীর বেশকিছু ভাষা নিয়ে গবেষণা করলেও বাংলা ভাষার মতো এতো সুন্দর ভাষার অলঙ্কার নাকি আর কোথাও খুঁজে পাননি তিনি। বিশ্বভারতীতে পড়াশোনা করার সময়ে কিছু বাঙালি সহশিক্ষার্থীর সহচর্য এই বিষয়ে ভূমিকা রেখেছিল বলেও জানান।

“সেই থেকে বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা মনে করে আসছি। আর কোথাও বাঙ্গালি দেখলে দৌঁড়ি গিয়ে সাক্ষাৎ করি।”

বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে পারাকে নিজের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলেও দাবি করেন। তোমিও মিজোকামি বলেন, “আমি জাপানি, কিন্তু বাঙালি আর বাংলা ভাষার টান আমার হৃদয়কে সব সময় বলে দেয়- আমিও একজন বাঙালি।”

প্রবাস জীবনের গল্প ও অভিজ্ঞতা এখন থেকে আমাদের সরাসরি জানাতে পারেন। পুরো নাম ও সংশ্লিষ্ট ছবিসহ লেখা পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায় probash@bdnews24.com