দল গুছিয়ে আবার আন্দোলন: খালেদা

বছরের শুরুতে তিন মাসের সহিংস অবরোধ-হরতালের পর দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ফের সরকারবিরোধী আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2015, 11:15 AM
Updated : 18 July 2015, 04:49 PM

তবে তিনি বলেছেন, এবারের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ। দল গুছিয়েই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওই আন্দোলনে নামবেন তিনি।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত লাগাতার অবরোধ-হরতাল ডেকেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে না পারার মধ্যে আন্দোলনে ছেদ টেনেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট।

ওই আন্দোলনের মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু ঘটে মালয়েশিয়ায়। এক ছেলেকে হারানোর পর অন্য ছেলে তারেক রহমানকে প্রবাসে রেখে শনিবার ঈদুল ফিতর কাটে তার।

ঈদের দিন দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কূটনীতিক ও গণমান্য নাগরিকসহ সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরপর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগের ‘অপশাসনে’ জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে বলে আসা খালেদা জিয়ার কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল- বিএনপি রাজপথে সক্রিয় নয় কেন?

জবাবে তিনি বলেন, “বিএনপির নামে শুধু মামলা আর মামলা। আমাদের অনেক নেতা-কর্মী জেল আছে। কত ছেলে যে গুম হয়েছে, তার হিসাব নেই। কাজেই বিএনপিকে এখন পুনর্গঠিত হতে হবে। এরপর আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করব।”

‘জ্বালাও-পোড়াও’ এর বিরুদ্ধে দলের অবস্থান স্পষ্ট করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “আমরা সেই আন্দোলন করব, যে আন্দোলন দেশের জন্য হবে, মানুষের কল্যাণ হবে।

“আমরা জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুরের আন্দোলনে বিশ্বাস করি না। সেই আন্দোলন আমরা করিনি। কারা জ্বালাও-পোড়াও করেছে, তা দেশবাসী জানে।”

তিন মাসের হরতাল-অবরোধে বহু বাস পুড়িয়ে এবং পেট্রোল বোমা ছুড়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য বিএনপিকে দায়ী করে আসছে সরকার। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, এর পেছনে সরকারের ষড়যন্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে সহিংসতার দায় কর্মসূচি আহ্বানকারী পক্ষ এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের। 

বিএনপির বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলছে দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, “বাংলাদেশে এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হচ্ছে বিএনপি। সেজন্য একে শেষ করতে তারা (সরকার) উঠে পড়ে লেগেছে।

“খবরের কাগজে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা রকমভাবে এজেন্সি ও গ্রুপের মাধ্যমে লেখানো হয়। বিএনপির বিরুদ্ধে বিভেদ, বিএনপিতে ‘ঐক্য নেই’, ‘এই হচ্ছে-সেই হচ্ছে’, ‘অমুক গ্রুপ-তমুক গ্রুপ’। আমি স্পষ্টভাষায় বলতে চাই- এগুলো কিছুই নয়। বিএনপি জনগণের সঙ্গে আছে, থাকবে।”

রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও তার জন্য দেশকে বিভক্ত করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন।

“বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনাময় দেশ। এই দেশকে সকলে মিলে গড়ে তুলতে হলে আমাদের সব বিভেদ ভুলে যেতে হবে। রাজনীতিতে দল থাকবে, তাই বলে যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, কেউ কারও চেহারা দেখব না। এটা কোনো রাজনীতি হতে পারে না।”

“আমাদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক খাকবে। পারিবারিক সম্পর্কও থাকতে পারে। কিন্তু রাজনীতি যে যার মতো করবে। হানাহানি-খুনাখুনি-মারামারি এগুলো রাজনীতি নয়,” বলেন তিনি।

‘মানুষ ভালো নেই’

আওয়ামী লীগের শাসনে বাংলাদেশের মানুষ ভালো নেই দাবি করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কিছুই মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নেই। রাস্তা-ঘাটের দুরবস্থার কারণে জনগণ যানজটের ভোগান্তিতে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, “প্রতিদিন কাগজ খুলে দেখা যাবে গুম-খুন-হত্যার খবর। দেশে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু আছে, তা মনে হয় না। প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি চলছে।

“দেশে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। যারা মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তারাও আজ জনগণকে জিম্মি করে ফেলেছে। তারা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) নিরাপত্তার নামে জনগণকে ধরে নিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে।”

কারাগারে হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জি কে গউসের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, “কারাগারে ঈদ জামাত পড়তে যাচ্ছিল গউস। তাকে ছুরি মারা হয়েছে। আজ কারাগারও নিরাপদ নয়।”

প্রশাসন, পুলিশের পাশাপাশি বিচার বিভাগেও দলীয়করণের অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

“আজ বিচার হয় দুই রকমের। সরকারি দলের হলে একরকম, আর বিরোধী দল হলে ভিন্ন রকম বিচার হচ্ছে। তারা জামিন পায় না, দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হচ্ছে। বিরোধী নেতা-কর্মীরা সুবিচার পায় না। অবৈধ সরকার এভাবে দেশটাকে কারাগার বানিয়ে রেখেছে।”

দুর্নীতি দমন কমিশনের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, “এটি একটি করাপশন কমিশনে পরিণত হয়েছে। এখানে শুধু করাপশনের আড্ডা। তারা ধরে নিয়ে গিয়ে টাকা নিয়ে তারপর কার বিরুদ্ধে মামলা দেবে, কার মামলা প্রত্যাহার করবে, ঠিক করে।”

খাদ্যমন্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “মন্ত্রীরা লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে। যে গম খাওয়ার অযোগ্য, সেই পচা গমকে যোগ্য প্রমাণ করে সবাইকে খাওয়াবে। ওই পচা ও পোকাওয়ালা গম টিআর, কাবিখার মাধ্যমে গরিব মানুষকে খাওয়াবেন, তা প্যাকেটের মাধ্যমে আটা হয়ে শহরেও চলে আসবে। তারপরও ওইসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন হয় না।”

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আবার জানিয়ে খালেদা বলেন, “দেশের মানুষ আজ অবাধ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। সরকার ওই রকম একটি নির্বাচন দিতে ভয় পায়।”

অনুষ্ঠানে কূটনীতিক-পেশাজীবী-রাজনীতিকরা

সকাল সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পেশাজীবী নেতাসহ দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে এবং সাড়ে ১২টা থেকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

ঢাকায় কূটনীতিক কোরের ডিন ফিলিস্তিনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত শাহের মোহাম্মদ এইচ আবুইয়াদেহ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দার নিকোলায়েভ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদন, পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলম, ভারতের হাইকমিশনার পংকজ শরণ, নেপালের রাষ্ট্রদুত হরি কুমার শ্রেষ্ঠাসহ ৩৯টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

কূটনীতিকদের সেমাই-জর্দাসহ মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, অধ্যাপক আ ফ ম ইউসুফ হায়দার, কলামনিস্ট মাহফুজউল্লাহ, আউয়াল ঠাকুর, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, চলচ্চিত্রকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, ছড়াকার আবু সালেহ, কবি মাহমুদ শফিক, কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীন বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

এছাড়াও ছিলেন সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রুহুল আমিন গাজী, এ্যাব নেতা আ ন হ আখতার হোসেন, সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ, আবদুল হাই শিকদার, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের নেতা জাকির হোসেন।

রাজনৈতিক জোটের নেতাদের মধ্যে ছিলেন কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, খন্দকার লুৎফর রহমান, জাপা (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, মুসলিম লীগের এএইচএম কামরুজ্জামান খান, ন্যাপের জেবেল রহমান গানি, ন্যাপ-ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ, বিজেপির সালাহউদ্দিন প্রকাশ।

শুভেচ্ছা বিনিময়কালে দলীয় নেত্রীর পাশে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, আ স ম হান্নান শাহ, জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ।

অনুষ্ঠানে দলীয় নেতাদের উপস্থিত ছিলেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আবদুল মান্নান, শাহজাহান ওমর, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও তার ছেলে তাবিথ আউয়াল, আবদুল হালিম, সুজাউদ্দিন, ইসমাইল জবিউল্লাহ, রুহুল আলম চৌধুরী, মাহবুবউদ্দিন খোকন, ফজলুল হক মিলন, জিয়াউর রহমান খান, আসাদুজ্জামান রিপন, এস এম ফজলুল হক, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, খায়রুল কবীর খোকন, নাজিমউদ্দিন আলম, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, তৈমুর আলম খন্দকার, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, মারুফ কামাল খান।

বিভিন্ন মামলা মাথায় নিয়ে হাবিব উন নবী খান সোহেল, মীর সরফত আলী সপু, শফিউল বারী বাবু, সাইফুল আলম নিরবও এই অনুষ্ঠানে আসেন।

সহযোগী সংগঠনের নেতাদের আনোয়ার হোসেন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মুনির হোসেন, এম এ মালেক, আবু তাহের, তকদির হোসেন মো. জসিম, নুরে আরা সাফা, শিরিন সুলতানা, হাফেজ আবদুল মালেক, শামা ওবায়েদ, আকরামুল হাসান উপস্থিত ছিলেন।

কবর জিয়ারত

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে খালেদা জিয়া শেরে বাংলা নগরে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দেন এবং মোনাজাত করেন।

পরে তিনি বনানী কবরস্থানে ছোট ছেলে আরাফাতের কবর জিয়ারত করেন। এ সময়ে আরাফাতের দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে দাদির পাশে ছিলেন।

পরে তিনি দুই নাতনিকে গাড়িতে নিয়ে গুলশানের বাসায় চলে যান।