কলম পাইলেই মিথ্যা নয়: প্রথম আলোকে মতিয়া

বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদে বলেছেন, অসত্য তথ্য পরিবেশন করা সাংবাদিকতার নীতিমালা পরিপন্থি।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2015, 05:11 PM
Updated : 17 June 2015, 12:29 PM

২৭ মে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি সংবাদের পর সরকারি তদন্তে সে খবরের সত্যতা পাওয়া যায়নি জানিয়ে মন্ত্রী মঙ্গলবার আইনসভায় ৩০০ বিধিতে একটি বিবৃতি দেন।

সংসদে ৩০০ বিধির বিবৃতির পর সম্পূরক প্রশ্নের সুযোগ থাকে না। মন্ত্রীরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কোনো বিষয়ে এই বিধিতে বিবৃতি দেন। 

পত্রিকাটিতে ‘কলের লাঙলের ভর্তুকির বড় ভাগ সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের পকেটে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ওই সংবাদের পর কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয় বলে জানান মন্ত্রী মতিয়া।

ষাটের দশকে মতিয়া যখন বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানও তখন ছাত্র সংগঠনটির মধ্যম সারির নেতা ছিলেন। মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বের পর ছাত্র ইউনিয়নের শামছুদ্দোহা নেতৃত্বাধীন কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন মতিউর।

পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও দলটির মুখপত্র একতার সম্পাদক ছিলেন।

সাবেক রাজনৈতিক সহযোদ্ধা সম্পাদিত পত্রিকার সমালোচনা করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, “প্রথম আলো একটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা। আমরা অনেকেই আগ্রহের সঙ্গে এটা পড়ি। দেশে তাদের বহু পাঠক আছে। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।

“কিন্তু কলম হাতে পাইলেই মিথ্যা কথা লেখা। কলম হাতে পাইলেই অসত্য তথ্য পরিবেশন করা, এটা সাংবাদিকতার নীতিমালার বিরোধী।”

সততার জন্য গণমাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া এই মন্ত্রী বলেন, “এই ধরনের সাংবাদিকতা প্রথম আলোর মতো পত্রিকা করবে, সেটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। এই জন্যই এই রিপোর্টটা আমি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরলাম।”

সংসদে উত্থাপিত বক্তব্য প্রথম আলোতেও পাঠানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি কাগজেও পাঠাইছি। আমি জানি, কালকে তিন লাইন ছাপাবে। বড় জোর চার লাইন ছাপাবে। তারা সেইটুকুই প্রকাশ করেন যেটুকু তাদেরকে টাচ করে না।”

পত্রিকাটির সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে সরকারি তদন্ত দল ডেকেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদের সংবাদদাতা কমিটির সামনে উপস্থিত হবেন না। আমরা তো শুধু কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে এই কমিটি করি নাই।

“কাজেই এই ধরনের সাংবাদিকতা তারা যত পরিহার করবেন, এটা দেশবাসীর জন্য মঙ্গল। তাদেরও সাংবাদিকতায় সুনামের জন্য অবশ্যপালনীয় শর্ত।”

খবর সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে পাওয়ার টিলার ক্রয়ে শতকরা ২৫ ভাগ ভর্তুকি সরকার দেয়। বাকিটা কৃষককে দিতে হয়।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলায় ভর্তুকি পাওয়া ১৫ জনের আটজনই যুবলীগের নেতা-কর্মী। বাকি সাতজন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মী।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “সরকার থেকে ভর্তুকির টাকা নিলেও এই ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ছয়জন কলের লাঙল কিনেছেন। বাকি নয়জন যন্ত্র না কিনে ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তুলে নিয়ে গেছেন।”

কৃষিমন্ত্রী জানান, প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর তদন্ত কমিটি দুইদিন এলাকায় গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে।

কমিটির সদস্যদের নামও জানান তিনি সংসদে। তারা হলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধি শাখার আব্দুল ওয়াদুদ, পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রিপন এবং বখতিয়ার হোসেন।

মতিয়া চৌধুরী (ফাইল ছবি)

মতিয়া চৌধুরী বলেন, এলাকায় প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর কৃষকদের নাম প্রকল্পের সদরদপ্তর থেকে চূড়ান্ত করা হয়। এরপর ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে চুক্তি স্বাক্ষরের পর তাদের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়।

“উক্ত প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে উক্ত কৃষকগণ ভর্তুকির অর্থ বাদে অবশিষ্ট ৭৫ভাগ অর্থ পরিশোধ করে তাদের নিজ নিজ সরবরাহকারীর নিকট থেকে পাওয়ার টিলার ক্রয় করেন, যা উপজেলা সদরে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নিকট বিতরণ করা হয়।”

“এরপর সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র প্রকল্প সদর দপ্তরে গৃহিত হলে সেখান থেকে ভর্তুকির টাকা অনুমোদিত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি পরিশোধ করা হয়।”

তদন্তের ফল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এক্ষেত্রে উপজেলায় কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। তাছাড়া নির্বাচিত কৃষকদেরও ভর্তুকির টাকা সরাসরি দেওয়ার কোনো বিধান নাই। দেওয়াও হয়নি।

“তদন্তকালে নির্বাচিত কৃষকদের বাড়িতে বা খামারে চুক্তিপত্রে উল্লেখিত পাওয়ার টিলার পাওয়া গেছে। কৃষকদের মধ্যে রাফি এন্টারপ্রাইজ থেকে ১৩ জন এবং কাদের মেশিনারিজ থেকে দুজন পাওয়ার টিলার কিনেছে। প্রতিটি যন্ত্রে অমোচনীয় কালি দিয়ে নিম্মোক্ত কথা আছে, ‘সরকারি ভর্তূকিমূল্য সরবরাহকৃত। হস্তান্তরযোগ্য নহে। খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’।”

ভর্তুকিপ্রাপ্তরা সবাই আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট নয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “তদন্তকালে দেখা যায়, ১৫ জনের সবাই প্রকৃত কৃষক। তাদের প্রত্যেকেরই আবাদি জমি, কারও কারেও বর্গা জমি রয়েছে। প্রকল্পের নীতিমালা অনুসারে তারা সবাই ভর্তুকি পাওয়ার উপযুক্ত। নীতিমালার শর্ত মেনেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদেরকে বাছাই করা হয়েছে।

“১৫ জন কৃষকের মধ্যে ৬ জনের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও বাছাই প্রক্রিয়ায় এই পরিচয় ভূমিকা রেখেছে বলে তদন্তকালে প্রতীয়মান হয় নাই।”

“তদন্ত কমিটি বলেছে, নির্বাচিত ১৫ জন কৃষকের প্রত্যেকেই পাওয়ার টিলার কিনেছে। কাজেই প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে অভিযোগ, ভর্তুকি পাওয়া ১৫ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জন পাওয়ার টিলার কিনেছে। বাকী ৯জন যন্ত্র না কিনে ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। এটা একেবারেই ভিত্তিহীন।

“ভর্তুকির টাকা কারও হাতে দেওয়া হয় না। কোম্পানিকে দেওয়া হয়। প্রকাশিত সংবাদে পাওয়ার টিলার না কেনার দায়ে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত আব্দুল খালেক, ফারুক আহাম্মেদ, ফিরোজ আলম, আজিজুল হকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ চরম অসত্য।”

ফারুকের প্রকৃত নাম ফারুক মোহাম্মদ বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী।

তিনি বলেন, তদন্তকালে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক আজাদ রহমানের সঙ্গে কথা বলতে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি কমিটির সামনে হাজির হননি।

সংবাদে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া না যাওয়ায় ওই সংবাদদাতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কমিটি সুপারিশ করেছে বলেও মতিয়া জানান।