বাবার চেয়ারে সাঈদ খোকন

দুই দশক আগে মাছ প্রতীক নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। ভোটের লড়াইয়ে তিনি তখন হারিয়েছিলেন বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2015, 11:32 PM
Updated : 29 April 2015, 12:01 PM

২১ বছরের ব্যবধানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে প্রার্থী হন হানিফেরই ছেলে সাঈদ খোকন। বাবার মতোই প্রতীক ইলিশ, প্রতিদ্বন্দ্বীও সেই মির্জা আব্বাস।  

সেবার মির্জা আব্বাসের সাইকেলের রথ যেমন থামিয়ে দিয়েছিলেন হানিফ, প্রতীক বদলে এবার মগ নিয়েও লড়াইয়ে উৎরাতে পারলেন না এই বিএনপি নেতা।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রায় আড়াই লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতে বাবার চেয়ারে বসতে চলছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খোকন।

দিনভর ভোটগ্রহণের পর ভোরে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ ফল ঘোষণা করলে দেখা যায়, ইলিশ প্রতীকে সাঈদ খোকন পেয়েছেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট।

৮৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে স্থগিত তিনটি বাদে বাকিগুলোতে ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট পাওয়া ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস অবশ্য ভোটগ্রহণের মাঝপর্যায়েই কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

এ নিয়ে সাঈদ খোকনের প্রতিক্রিয়া ছিল এই রকম- “উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় মির্জা আব্বাসের বের হয়ে যাওয়াটা ছেলেমানুষী।”

ঢাকা দক্ষিণের মতো ঢাকা উত্তর এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিরতি দিয়ে সিটি নির্বাচনে আসা বিএনপি।

গত তিন মাসের হরতাল-অবরোধে নাশকতার খাঁড়া গেছে মির্জা আব্বাসের ওপর দিয়েও। প্রার্থী হলেও গ্রেপ্তার এড়াতে প্রকাশ্যে ভোটের প্রচারে আসেননি তিনি, তার হয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচার চালিয়ে যান স্ত্রী আফরোজা আব্বাস।

মঙ্গলবার ভোট দিতেও বের হননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। সমর্খকদের ভোট দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে ব্যালট পেপারে সিল মারেননি আফরোজাও।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট প্রাইমারি স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের যে কোনো ফল মেনে নেবেন তিনি।

ভোটের প্রচারের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর স্ত্রীর অনেক অভিযোগ সাঈদ খোকন সামলেছেন অনেকটা কূটনৈতিকভাবে। আফরোজাকে ‘চাচি মা’ ডেকে মির্জা আব্বাসকে ‘মুরুব্বি’ সম্বোধন করে বিরুদ্ধ প্রচারের জবাব দেওয়া এড়িয়েছেন হানিফপুত্র।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হানিফ ভোটে জিতেছিলেন প্রতিকূল অবস্থায়, তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। তবে সাঈদ খোকন জিতেছেন নিজের দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এবং ভোটে অনিয়মের কিছু প্রমাণ গণমাধ্যমেও এসেছে। 

মেয়র থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আলোচনায় ছিলেন হানিফ।

২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে হানিফের ভূমিকাকে বঙ্গবন্ধুর স্নেহের ঋণ শোধ হিসেবেই দেখেন তার ঘনিষ্ঠরা। যখন মারা গিয়েছিলেন, তখনও তার মাথায় বিঁধে ছিল স্প্লিন্টার।

বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে নামেন পুরান ঢাকার মাজেদ সর্দারের নাতি সাঈদ খোকন, ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ড শাখার আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগে নাম লেখান।

১৯৯৯ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে অংশগ্রহণ, পরে ২০০৪ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি।

তবে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ‘কিংস পার্টি’ পিডিপিতে যোগ দিয়েছিলেন সাঈদ খোকন। তবে তার দাবি, সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় চাপে পড়ে তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।     

সাঈদ খোকনের মাথায় মেয়র হওয়ার চিন্তা আসার পেছনেও বাবার সাফল্যটাই প্রেরণা ছিল বলে ভোটের প্রচারের মধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি।

“২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলায় বাবা মারাত্মক আহত হন, পরে মারা গেলে ঢাকার মানুষের মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তখন থেকে এলাকাবাসী ও ঢাকার মানুষের উৎসাহের কারণে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে মেয়র হওয়ার স্বপ্নটা চলে আসে।”

হানিফ যখন মেয়র ছিলেন, তখন ঢাকায় ছিল একটি সিটি করপোরেশন। পরের নির্বাচনে বিএনপির সাদেক হোসেন খোকাও ছিলেন অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের মেয়র।

চার বছর আগে রাজধানীকে উত্তর-দক্ষিণে ভাগ করে দুটি সিটি করপোরেশন হলেও এই নগরীর সমস্যাগুলো একই। 

মেয়র হলে যানজট নিরসনকেই প্রার্থী হিসেবে নিজের ইশতেহারে অগ্রাধিকার দিয়েছেন সাঈদ খোকন। খেলার মাঠ, ফুটপাত, হকার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যার সমাধানের আশ্বাসও রয়েছে তার।

জটিল এসব সমস্যা সমাধানে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে নগরবাসী সবাইকে সম্পৃক্ত করাকেই মূল চাবিকাঠি মনে করছেন তিনি।

“আমি তরুণ, উদ্যমী, আমার মধ্যে কাজের স্পৃহা আছে, আমি পারব,” এটা ছিল তার ভোটের আগের কথা।

আর জয় যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন তিনি বললেন, “মেয়র নির্বাচিত হলে উন্নয়ন কাজের বিএনপিসহ সব দলকে চাইব। আমি প্রত্যাশা করি, তারা সহযোগিতা করবে।”